বিষয় যখন কবি রবীন্দ্রবীক্ষণ এবং অনুসন্ধান
আমরা স্বভাব উন্নাসিক বাঙ্গালীরা যাঁদের নিয়ে শ্লাঘা বোধ করি তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে যে নামটি মনে আসবে তা নিয়ে অধিকাংশেরই কোনও দ্বিমত থাকা উচিৎ নয়। অবশ্যম্ভাবী সেই নামটি রবীন্দ্রনাথ। ফি বছর তাঁর জন্মতিথিতে ও মৃত্যুদিবসে তাঁকে স্মরণ করি আমরা, তাঁরই রচনা, গান ও তাঁর মহৎ প্রতিভা প্রসূত আরও নানান সৃষ্টির মাধ্যমে, যেমন গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো। এই মানুষটিকে নিয়ে আমাদের কৌতূহলেরও সীমা নেই। তাঁর ঐশী প্রতিভার মত তাঁর জীবনের ব্যাপ্তি, তাঁর জমিদার বাড়ির ছোট ছেলে শখের কবি থেকে এক মহান স্রষ্টা হয়ে ওঠা, সেই থেকে একজন মনীষী, সর্বোপরি একজন মহামানব হয়ে ওঠার আখ্যান, এই বিশাল ব্যাপৃত জীবনের অতলান্তিক গভীরতাকে স্পর্শ করা দূরস্থান, তাতে ডুব দেওয়াই একজনের পক্ষে পরম সমৃদ্ধির বিষয় হতে পারে।
তাঁর জীবন নিয়ে গবেষণা ধর্মী কাজ হয়েছে প্রচুর এবং বলাই বাহুল্য আরও হতে থাকবে এবং তার ব্যাপ্তি যে শুধু আসমুদ্র হিমাচলেই সীমাবদ্ধ নয় তাও সকলেই জানেন। তবে তার অধিকাংশই হয় গড্ডালিকা স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া মুগ্ধতার বর্ণনা, যা রবীন্দ্রবীক্ষার পরিবর্তে অন্ধ ঈশ্বরপূজার সামিল, নয়ত এক্কেবারে উল্টোদিকে হেঁটে অর্বাচীনদের কঠোর সমালোচনা, আক্রমণ, তাঁর কীর্তির অন্তঃসার অনুসন্ধানের চেষ্টা না করেই তাকে অন্তঃসারশূন্য ঠাওরানো। তবে মুড়ি আর মিছরি আলাদা করার দায় অবশ্যই উৎসাহী পাঠকের। যে কতিপয় বই আমাদের দিশা দেখাতে পারে তার অন্যতম হল বুদ্ধদেব বসু বিরচিত 'কবি রবীন্দ্রনাথ'।
রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের বাংলা সাহিত্যে এক উজ্জ্বল নাম বুদ্ধদেব বসু। এই দিকপাল মানুষটি যখন সেই মহান কবির রচনাশৈলী, তাঁর অনুপ্রেরণা, তাঁর কবিতার অভিঘাত এসব সম্বন্ধে একটি পূর্ণাঙ্গ বই রচনা করেন তখন তা নিঃসন্দেহে আগ্রহী পাঠকের পক্ষে এক পরম প্রাপ্তি। অবশ্য বইয়ের শুরুতেই তাঁর বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, 'রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু বলার জন্য আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। তাঁর পূর্ণ রূপ নয়, বাঙ্গালির সাহিত্যে ও জীবনে তাঁর সামগ্রিক অবদান নয়-বিশেষভাবে তাঁর কবিতাই আমার আলোচ্য। আমি জানি , এই কাজটিও সহজ নয়, কেননা সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েও তাঁর কবিতার পরিমাণ ও বৈচিত্র্য বিপুল। যেমন সাহিত্যের স্রষ্টা হিসেবে, তেমনি শুধু কবি হিসেবেও তাঁর বহুমুখিতা বিস্ময়কর। যেমন চিত্ররচনায় পিকাসো, তেমনি কাব্যরচনায় বিশ্বম্ভর আমাদের রবীন্দ্রনাথ।'
না, পূর্বেই বলেছি, উপরোক্ত অংশটি থেকে এ মনে করার কোনও কারণ নেই যে এই বইও কবিগুরুর পাদপদ্মে আরেকটি পূজার ফুল। তা ভাবলে পাঠক খুবই ভুল করবেন, বরং যখন তিনি বলছেন '"বিশ্বকবি", "ভারতের গ্যেটে", "বুডোয়ার পোয়েট"- যথাক্রমে পার্ল বাক্, শ্ভাইতসর ও এলেন গিন্সবার্গ এর এই তিনটি মন্তব্যই সমান অর্থহীন' তখন আমাদের মধ্যে যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে এক দৈবলোকের বাসিন্দা হিসেবে পূজিত হতে দেখতেই অভ্যস্ত তাঁদের মনে এই মন্তব্য এক গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করতে বাধ্য, কিন্তু পরক্ষণেই এর কারণ ব্যাখ্যা স্বরূপ তিনি বলছেন, 'কেননা এদের কারোরই কোন ধারণা নেই কোন্ জাতীয় দানব বা কিন্নরের নাম রবীন্দ্রনাথ'।
অপেক্ষাকৃত তরুণ সাহিত্যিক বা কবি যাঁরা রবীন্দ্রনাথের মর্মস্পর্শী ও সতত 'পেলব যামিনী' ভাষার ধারার বা ঘরানার তীব্র বিরোধী, কেউ কেউ এক পা এগিয়ে তাঁকে অস্বীকার করতেও উদ্যত তাঁদের প্রতি তাঁর সস্নেহ আবেদন ধরা পড়ে যখন তিনি বলেন 'আজকের দিনের সেইসব তরুণ, যাঁরা বহু বিভিন্ন কাব্যরীতির সাথে পরিচিত, এবং রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে উৎসাহী নন, বিশেষত তাঁদের উদ্দেশে দু একটি কথা বলতে চাই।' লেখক আরও বলছেন 'তাঁর কবিতায় তীব্রতা নেই, নেই কোনও বিসংবাদী সুর, তাঁর কোন পঙক্তি হাতুড়ির মত আঘাত করে না।'
'রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রাতিস্বিক কাব্যগ্রন্থ "মানসী"' থেকে শুরু করে তাঁর বিভিন্ন পরবর্তী কাব্যগ্রন্থে তাঁর দর্শন, তাঁর চিন্তাধারা, কবিতার বিষয় কিম্বা কাব্যের উদ্দিষ্ট বা উদ্দিষ্টা, প্রতিটি বিষয়ে তাঁর গভীর চুলচেরা বিশ্লেষণ এই সবই এই বইটির পেছনে তাঁর বিপুল পরিমাণ পরিশ্রম এবং বিষয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসার সাক্ষ্য বহন করে। কোথাও তিনি রবীন্দ্রনাথের কাব্যের অগভীর উৎপ্রেক্ষা সম্পর্কে সরব কোথাও বা ছত্র তুলে ধরে দেখিয়ে দিচ্ছেন কোথায় আমাদের কবি বিলেতের শেলীর সাথে মিশে একাকার।
বইটির শেষাংশে তিনি আলোকপাত করেছেন অনুবাদক রবীন্দ্রনাথের প্রতি এবং অনিবার্য ভাবেই এসে পড়েছে তাঁর নোবেল প্রাপ্তির সেই মাহেন্দ্রক্ষণের প্রসঙ্গ। প্রথমেই তিনি উল্লেখ করেছে যে 'গীতাঞ্জলী'-র ইংরিজি অনুবাদের কাজ তিনি শুরু করেছিলেন নেহাতই খেলাচ্ছলে এবং রবীন্দ্রনাথ নিজে 'হিন্দু কলেজের শেক্সপীয়র-বায়রন আওড়ানো ছোকরা' ছিলেন না এবং ভাষাটির সাথে তাঁর যোগ ছিল- 'ঘনিষ্ঠ নয়, সৌজন্যসম্মত' তখন তাঁরই প্রণীত ইংরিজি 'গীতাঞ্জলী'র বিশ্বজয় এক আশ্চর্য এবং দৈব ঘটনা বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখের মাধ্যমে লেখক এও জানিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর অনুবাদ কর্মের উপর যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না। বিলেতের পরিচিত সাহিত্যিক মহলে তিনি তাঁর ইংরিজি 'গীতাঞ্জলী' 'কুণ্ঠিত মনে সমর্পণ' করেছিলেন, কিন্তু চিত্রকর বন্ধু উইলিয়াম রোটেন্সটাইন এর উচ্ছ্বাসে তিনি বেশ আশ্চর্য হয়েছিলেন, বলাই বাহুল্য যে সেটি তাঁর জীবনের একটি প্রসন্নতার ক্ষণ। এতে উৎসাহিত হয়ে তিনি ইয়েটসের সাহিত্যিক গোষ্ঠীর কাছে অপ্রকাশিত ইংরিজি 'গীতাঞ্জলী' পড়ে শুনিয়েছিলেন তখন 'stolid' ইংরেজরা একটি কথা না বলে একে একে বিদায় নিলেন' তখন তাঁর মনে হয়েছিল যে তিনি 'নিজের উপর লজ্জা ডেকে আনলেন, লজ্জা দিলেন তাঁর জন্মভূমিকে।' এই ঘটনা তিনি স্বয়ং গুরুদেবের নিজের মুখ থেকে শুনেছিলেন।
শুধু কবিতার ব্যকরণ, প্রকরণ ও তাত্ত্বিক আলোচনাই নয়, পাতায় হরেক টীকা, বিভিন্ন anecdotes বইটিকে এক সাধারণ গবেষণা পত্রের উর্ধ্বে এক মনোগ্রাহী পাঠ্য করে তোলে। রবীন্দ্রগবেষক ত বটেই, বইপোকাদেরও ব্যক্তিগত সংগ্রহে এই বই থাকা আবশ্যক, কারণ, ওই পূর্বেই ব্যাখ্যা করে হয়েছে, ওই মহামানবের জীবন সমুদ্রে ডুব দেওয়ার ব্যাপারটা!