বিগত দশ বছর ধরে আমরা বিরাজমান। কিছু প্রউক্তুশিল কারণে আমাদের মেইন ওয়েবসাইটটি কিছুদিন বন্ধ ছিল। আমাদের কাজ চলছে, আমরা আবার আসিব ফিরে। কিন্তু ততদিন আমাদের এতদিনের আর্কাইভটা প্রকাশ করা থাকল। অনেক পুরনো জিনিসপত্র পাবেন, যদি কারর কন আপত্তি থাকে আমাদের কে মেইল করে জানাবেন। admin@werbangali.com
আপনি যদি আমাদের e-commerce shop খুজ্জেন তাহলে এই লিঙ্ক এ ভিজিট করুন : shop.werbangali.com

তখন নিরুত্তর (প্রথম পর্ব) (Then Unanswered) (1 st Part) - Sarthak Goswami

মামার বাড়ি যাওয়ার আনন্দ যে কতটা, তা নিশ্চয় আর বলে বোঝাবার দরকার নেই। সেই কারনেই মনটা খুব মেতে ছিল। তার উপর উপলক্ষটা ছিল আরও আনন্দের। রামপুরের হালদারবাড়ির কালিপুজো শুধু আরম্বরে নয়, আয়োজনের দিক থেকেও ছিল বিশাল। মামারবাড়ি যত পুরোনো, কালিপুজা বোধহয় তার থেকেও পুরোনো। এখন হয়তো সেই আরম্বর আর নেই কিন্তু আয়োজনের কোনো ত্রুটি থাকেনা। আমার মায়ের জীবনটা বেশ অন্যরকম বিয়ের আগে খাঁটি শাক্ত আর বিয়ের পর খাঁটি বৈষ্ণব। সে যা পুজোই হোক, যেকোনো পুজোই আমাদের ছোটোদের কাছে বিশাল আনন্দের। তখন আর বয়সইবা কত – ঐ ১২ থেকে ১৪ হবে। তাই যেকোনো কিছুতেই আনন্দ খুঁজে নেওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল ছিল।   

       কালিপুজোর দিন সকাল ৯টায় রামপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে হেঁটে এগোতে লাগলাম। আগে ঠাকুরচালা, তারপর মাঝেরবারি নামক ফাঁকা জায়াগা, তারপর মামারবাড়ি। তাই, প্রথমেই ঠাকুরচালার দিকে লক্ষ্য পড়ল। বাপি-মা কে বললাম – “তোমরা এগিয়ে যাও, আমি ঠাকুর দেখে এগোচ্ছি।” জুতোখুলে ঠাকুরচালাতে উঠলাম। সিদ্ধেশ্বরী কালিমায়ের মুর্তি দেখে মন জুরিয়ে গেলো। হঠাৎ, পিছন থেকে কে যেন ডেকে উঠল - ‘কিরে কি খবর?’  তাকিয়ে দেখি -পল্টুদা। আমি বললাম- “আরে পল্টুদা যে- ভালো আছো? আমারতো , এই চলছে আর কি?”

-     আমারও চলছে। তোরা তিনজন শুধু এলি ? আরে ইন্দ্রানীদি, আর ঈপ্সিতা এলো না?

-     আরে না, দিদিদের শরীর খুব একটা ভালো নেই। আর বাপি-মা তো এগিয়ে গেল।

-     হুম। পিসি- পিসেমশায়ের সঙ্গে কথা হল। তোদেরতো আজ বাসের জন্য অনেকক্ষন দাঁড়াতে হয়েছে?

-     হ্যাঁ গো। সে আর বলোনা।

-     ঠিক আছে যা, পরিষ্কার হয়ে কিছু খেয়ে নে। পরে দেখা হবে।

-     ঠিক আছে আসছি।

মামারবাড়ি ঢুকে হাত- মুখ ধুয়ে, দালানে বসলাম। মেজমামীমা একপ্লেট মিষ্টি দিল এবং জিজ্ঞাসা করল, “কিরে এতক্ষন কি করছিলি?”

আমি বললাম, “এই পল্টুদার সঙ্গে দেখা হল, একটু কথা বলছিলাম।”

মেজমামীমা হেসে বলল, “ সত্যি তোর রসিকতা একটুও কমেনি। কি যে বলিস। পল্টুতো কবে মাড়া গেছে । ”

আমি বললাম, “তার মানে?”

মেজমামীমা বলল, “তুই কি বলবি, আমি বলছি - তার মানে তুই কি বলতে চাইছিস যে তুই আজকাল ভুতের সঙ্গেও কথা বলতে পারিস?”

আমি বললাম, “আরে বাবা আমি কি মিথ্যা বলছি নাকি?”

আনিকদাদা বলল, “আসলে পড়ে পড়ে, তুই পড়ার চিন্তায় পাগল হয়ে গেছিস, অথবা আমাদের পাগল ভাবছিস। ”

আমি বললাম, “আরে বাবা...”

আনিকদাদা বলে উঠল, “উল্টোপাল্টা না বকে তাড়াতাড়ি জামা ছাড়, অনেক কাজ বাকি। চল ঠাকুরদালানের চাঁদোয়াটা খাটাতে যাব। ”

তারপর আমি আর অনিকদাদা বেরিয়ে পরলাম। মামারবাড়ি আর ঠাকুরদালানের মাঝের ফাঁকা হাঁটার পথটাকে সবাই মাঝেরবাড়ি বলে। অনিকদাদা বলতে লাগলো , “আজ কিন্তু সারা রাত জাগতে হবে। ব্যাপক মজা হবে।......” কথাগুলো যেন আমার কানে ঢুকছিলো না। মনের ভিতরে দ্বন্দ্ব চলতে শুরু করল। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল ,মন যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। শরীরটা যেন ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠতে লাগছিল।

ঠাকুরদালানে উঠতে গিয়ে দেখি একদিকে, পল্টুদা একটা ছোটো বাঁশের টুকরো নিয়ে দেওয়ালের গায়ে ঠেসান দিয়ে বসে আছে। দেখেই যেন হৃদস্পন্দনটা বন্ধ হয়ে গেলো। পল্টুদা যেমনি বাঁশের টুকরোটা পাশের দিকে রাখল, অনিকদাদা উপরে উঠে বাঁশের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলেদিল, আর বলল – “কেউ একটা কাজের নয়।”

উফ্ , প্রানটা যেন বাঁচলো। বুঝলাম, সবাই আমায় বোকা বানাচ্ছিল। তারপর, আমি আর অনিকদাদা দুজনে চাঁদোয়া টাঙানো শুরু করলাম। হঠাৎ শুভদাদার মা এসে দালানে দাঁড়ালো, আর বলল- “প্রতি বছর পল্টুটা মণ্ডপ সাজায়, পল্টুটা চলে গেল এমনভাবে, সত্যি ভাবা যায় না। ”

আমি বললাম , “মামীমা – কোথায় গেছে গো – পল্টুদা ? ”

শুভদার মা বলল , “কেনোরে তুই জানিসনা ? ছ – সাত মাস আগে অ্যাকসিডেন্টে , পল্টু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। ”

আমি বললাম, “কি ? এইতো দালানের বাইরের দিকে পল্টুদা বসে আছে। ”

অনিকদাদা কিছুটা রাগের সঙ্গে বলল, “ তুই দিনদুপুরে ভুত দেখছিস নাকি? পাগলের মত বকাটা বন্ধ কর। চুপচাপ চাঁদোয়াটা ভালো করে ধর। কাজে মন দে।”

আমি বললাম, “দেখ আমাকে বোকা বানাস না। দালানের ওই দিকে পল্টুদা বসে ছিল তো। পল্টুদার হাতে বাঁশের ছোটো টুকরোটা ছিলো। তারপর টুকরো পাশের দিকে রাখলো। আরে বাবা – তুই দালানে উঠে যেটাকে ফেললি।”

অনিকদাদা বলল, “ আরে ওটা তো আগে থেকেই কেউ ওখানে রেখে গিয়েছিলো । পল্টুতো  ওই দিকে ছিলোই না। দেখ, যেটা বাস্তব সেটা মেনে নে। উল্টোপাল্টা , অবাস্তব কথা বলিস না। ”

শুভদার মা দাঁড়িয়ে সব শুনছিল , শেষে বলল, “জ্বলজ্যান্ত ছেলেটা চলে গেলো । সে কোথা থেকে আসবে ? তোরা উল্টপাল্টা বকে কাজে ফাঁকি দিস না। ভালো করে সাজা। অনেক কাজ আছে। কাজের অভাব নেই। ” তারপরে আমাকে কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল, “যে ছেলেটা এতো কষ্ট পেয়ে, সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে, তার নামে মিথ্যে কথা বলতে তোর ভালো লাগছে? অন্তত বড়দের সামনে ইয়ার্কি করিস না। ”

আমি খুব বিষ্ময়ের সাথে বললাম, “তার মানে অমিই ভুল ! ”

শুভদার মা খানিকটা রেগে বলল, “না না । তা কেনো হবে? তুই একা ঠিক। আমরা সবাই ভুল। ” এই বলে ঠাকুরদালান থেকে নেমে চলে গেল।

অনিকদাদা আমায় বলল, “ইস । পিছনে টাঙানোর কাপড়টা আনতে ভুলে গেছি।  তুই বাড়ি থেকে গিয়ে নিয়ে আয়। আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। ”

দালান থেকে নেমে মাঝেরবাড়িতে এসেছি দেখি সামনে পল্টুদা দাঁড়িয়ে, হাল্কা হাসছে। আমারতো বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে গেলো। কি করব কিছুই মাথায় আসছিল না।

হঠাত করে, পল্টুদাই বলল, “কি হল?”

-     না মানে তুমি !!

-     হ্যাঁ, আমি তো কি হয়েছে? আমি একটু বাড়ি গিয়েছিলাম। এবারে কিন্তু আমাদের বাড়ি একবার হলেও ঘুড়ে আসিস। আগেরবারে তো গেলিই না আমাদের বাড়ি।

-     তার মানে , তুমি বেঁচে আছো?

-     ( হাল্কা হেসে) আরে হঠাত মরব কেনো?

-     আরে, সবাই বলছে তুমি মরে গেছো ।

-     কি? এ আবার কি কথা ?

-     দেখো, পল্টুদা তুমি আমায় ভয় দেখিও না।

-     আরে আমি তো তোর সাথে কথা বলছি। আর তুই উল্টোপালটা বকছিস।

-     দেখো আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা যে তুমি বেঁচে আছো। প্রমান দাও তুমি।

-     আরে , এত দূরে থাকলে কি করে প্রমান দেবো ? আচ্ছা, তুই কাছে এসে আমার হাতটা ছঁইয়ে দেখ। তাহলেই প্রমান পেয়ে যাবি। আয় কাছে আয়।

 

আমার মনের ভিতর ভয়টা পাঁচগুন বেড়ে গেল। কিছুক্ষন স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর মনে সাহস এনে , একসময়ের খেলার সঙ্গী পল্টুদার হাত ধরতে এগিয়ে গেলাম। যত কাছে যাই , ভয়টা ততই বেড়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে যে কি চলছে, সেটা কাউকে বলে বোঝানো যাবেনা। অবশেষে মনের সমস্ত সাহস দিয়ে পল্টুদার হাতটা জোরে চেপে ধরলাম। এটা অনুভব করলাম – হাতটা প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কিন্তু আমি ধরতে তো পেরেছি – পল্টুদার হাতটা। তাই এক নিমেশে মনের সব ভয় দূর হয়ে গেল।

আমি বললাম, “দেখেছ !  সবাই মিলে আমায় কেমন বোকা বানাচ্ছে। ভুতকে কি আর ছোঁয়া যায়? ”

তারপরে আমি মামারবাড়িতে ঢুকে মেজমামীমাকে বললাম, “ঠাকুরের কাছে , পিছনে টাঙানোর কাপড়টা দাও তো।”

মেজমামীমা কথাটা শুনে ঘরের ভিতর থেকে কাপড়টা এনে আমার হাতে দিল এবং বলল , “তোরা ওখানে কে কে আছিস? ”

আমি বললাম, “ আপাতত তো আমি আর অনিকদাদা। শুভদা আসেনি। পল্টুদার সঙ্গে মাঝেরবাড়িতে কথা হল, একটু পড়ে আসবে মনে হয়। ”

মেজমামীমা আবার বিরক্তির সুরে বলল, “পুজোর দিনে মজা করাটা ছাড়। পল্টু কোথা থেকে আসবে? ”

আমিও রেগে গেলাম। তারপর বললাম, “ আরে পল্টুদার সঙ্গে সকালে বাপি মায়েরও কথা হয়েছে। তাইতো পল্টুদা বলল – আমাদের আসতে অসুবিধা হয়েছে। দাঁড়াও, বাপি মাকে ডাকছি , তাহলেই কোনটা সত্যি পরিষ্কার হয়ে যাবে। তোমরাই যত উল্টোপাল্টা বকছো। ”

না বলতেই মা দেখি দালানে এসে দাঁড়ালো। বোধহয় আমার গলা পেয়েই হবে। আমি জিগ্যেস করলাম, “আজ সকালে পল্টুদার সঙ্গে তোমাদের দেখা হয়েছে তো? বলোনা মামীমাকে। ”

মা বলল, “কই না তো ! পল্টুকে তো এবারে এসে থেকে দেখিই নি ।”

কথাটা শুনে আমার পুরো শরীরটা হাল্কা হয়ে গেলো। মাথাটায় একটা হালকা যন্ত্রনা অনুভব করলাম। কিছুটা বল নিয়ে মায়ের হাতটা আমার মাথায় রেখে বললাম, “মা তুমি আমার মাথায় হাত রেখে বলো – যে তুমি সত্যি কথা বলছ। কারন আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।”

মা হালকা হেসে আমার মাথায় হাত রেখে বলল, “ কি পাগলামি শুরু করলি। হাঁ রে বাবা সত্যি বলছি। এবারে এসে থেকে পল্টুকে দেখিই নি। ”

হঠাত যেন মাথাটা ঘুরে গেলো। বুকে একরাশ ভয় নিয়ে আমি দালানে বসে পড়লাম।

 

 

 

গল্পের পরবর্তী অংশ “ তখন নিরুত্তর ” দ্বিতীয় পর্বে।