বিগত দশ বছর ধরে আমরা বিরাজমান। কিছু প্রউক্তুশিল কারণে আমাদের মেইন ওয়েবসাইটটি কিছুদিন বন্ধ ছিল। আমাদের কাজ চলছে, আমরা আবার আসিব ফিরে। কিন্তু ততদিন আমাদের এতদিনের আর্কাইভটা প্রকাশ করা থাকল। অনেক পুরনো জিনিসপত্র পাবেন, যদি কারর কন আপত্তি থাকে আমাদের কে মেইল করে জানাবেন। admin@werbangali.com
আপনি যদি আমাদের e-commerce shop খুজ্জেন তাহলে এই লিঙ্ক এ ভিজিট করুন : shop.werbangali.com

সর্পাঘাতে সম্বিত - Sarthak Goswami

সময়টা অবশ্যই বসন্তকাল। আরও নিখুঁত ভাবে বললে, ফাল্গুনের শেষ বা চৈত্রের শুরু। কারন – মনটা তখন বসন্ত আবির মেখে ফুরফুর করে উড়ছিল। এই সময় ওপাড়া বা দোলতলা নানা রঙে রেঙে উঠত। কারনটা আর কিছুই নয়, কারনটা দোল উৎসব। শিবরাত্রি পরবর্তী পুর্নিমা তিথিতে সব জায়গাতে দোল বা হলি পালন হলেও, আমাদের এখানের গোপীনাথের দোল হয় – প্রতিপদ তিথিতে অর্থাৎ পরাহে। দোল উৎসব উপলক্ষে সারা পাড়া সেজে উঠত। যারা বাইরে থাকত, তারা দোলের টানে গ্রামে ফিরে আসত। এ যেন সারা গ্রামের মিলনমেলা। ক্লাবের মাঠে, বিশাল মেলা চলে দোলের তিন দিন আগে থেকে তিন-চার দিন পর পর্যন্ত। আমাদের এখানে জলরঙ, গোলা রঙের ব্যবহার নেই – শুধু ব্যবহার করা হয় আবির বা ফাগ। দোলের দিন বিকালে সবাই নানা রঙের আবির মেখে বসন্তকে আহ্বান করি। গোপীনাথ-রাধারানী, গোপাল, নারায়নকে আবিরের সঙ্গে কীর্তন করতে করতে মন্দির থেকে দোলমন্দিরে আনা হয়। আবার, সন্ধ্যায় মহাসমারোহে ঠাকুর মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিভিন্ন গ্রামই নয় শহর থেকেও মানুষ ছুটে আসে হুগলী জেলার, সোয়ালুক গ্রামের, গোস্বামীপাড়ার এই মহান উৎসব দেখতে।

                   সে বছর এই মহান উৎসবে সামীল হতে সুদুর কলকাতার বাগবাজার থেকে এসেছিলেন গুরুদাদু অর্থাৎ শ্রীযুক্ত রামদেব ভট্টাচার্য ও গুরুঠাকুমা এবং তাঁদের ছোটো ছেলে শুভ।

শুভ অর্থাৎ শুভদেব ভট্টাচার্য – রোগা রোগা অথচ বলবান চেহেরা , চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি । আর, চলাফেরায় সাবেকিয়ানা ছিল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেবছর অনিকদাদাও এসেছিল আমাদের বাড়িতে।

ছোটাটাকে মজাদার খেলায় পরিনত করার প্রয়াস হিসাবে যে “গোল্লা” খেলার উৎপত্তি হয়েছিল – সেই খেলা মাঝেমধ্যেই হত। সবাই মিলে ক্লাবের বড় মাঠে তা খেলতাম। এই ঘটনাটা দোলের চার দিন আগের ঘটনা। ক্লাবের মাঠে দোলের মেলা বসায়, মাঠটা বেশ কয়েকদিন শুধু খেলারই নয় – বসে, গল্প করারও অবস্থাতেও থাকে না। দোলের পর ঝড়-বৃষ্টি হলে তবে মাঠ পরিষ্কার হয়, না হলে পা ফেলাও যায় না। তাই ঐ সময়টাতে গোপীনাথ মন্দিরের পিছনের মাঠটাতেই কেবলমাত্র খেলা হত। তাই আমরা ঘটনার দিন, সকাল ৯ টার সময় - গোপীনাথ মন্দিরের পিছনের মাঠটাতে গেলাম। আমরা বলতে বাড়ির সকল বুঝত, আমরা তিন-কে অর্থাৎ আমি, হরি আর চয়নকে। কিন্তু ওই দিন আমরা ছিলাম পাঁচ জন অর্থাৎ  আমি, হরি,চয়ন,অনিক দাদা, শুভ। তখন অয়ন-সায়ন বয়সে নিতান্তই ছোটো অর্থাৎ বছর পাঁচেক এর হবে। তাই ওরা তখন প্রতিদিন, আমাদের সঙ্গে প্লাস্টিক বলে  ক্রিকেট খেলায় অংশ নিতে পারতো না। আর, নিলেও উইকেটের পিছনে বল কুড়াতো এবং শেষে একবার ব্যাট নিয়েই খুশি থাকতো। তাই, অয়ন-সায়নের বাচ্ছা-দুষ্টুমির সাক্ষী আমরা হতে পারতাম না। তাছাড়া, আরো একটা ব্যাপার ছিল। বয়সে একটু বড় হলে - যে কেউ যে দাদাগিরি দেখাতে পছন্দ করে, তা তো আর বলতে বাকি নেই। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। চয়ন বয়সে বড় হওয়ায় , অয়ন-সায়নের ওপর সবসময় দাদাগিরি দেখাতো। এমনকি, বেশিরভাগ দিনই মেজদাকে বলে ওদের ক্রিকেট খেলার দফা-রফা করে ছাড়ত।

                   খেলা শুরু হল। শুভ বলল , “শুনলাম, তুই নাকি খুব ভালো ফিল্ডিং করিস ? ” বুঝতে অসুবিধা হল না, যে – কথাটা ও গুরুদাদুর মুখেই শুনেছে। গুরুদাদুর মুখে আমিও শুনেছি যে- ছেলেবেলায় আমি নাকি , টিভি দেখে ঘর থেকে দুয়ারে বল ছুঁড়ে সেই বল ক্যাচ লুফেছিলাম- আর গুরুদাদু তখন দুয়ারেই বসেছিলেন। আজ আমার স্মৃতিতে সেই দিনটা ভাসে না। তবু, গুরুদাদুর কথায় একটা কৃত্রিম স্মৃতি  মনের মণিকোঠায় পাকাপোক্তভাবে স্থান করে নিয়েছে।

কিছুক্ষন খেলা ভালোভাবেই চলল। তখন আমি ব্যাট করছি আর শুভ বল করছে। হঠাৎ , এমন একটা জিনিস আমার দৃষ্টি আকর্ষন করল , যে – বুকের ভিতরটা ধরাস করে উঠল। দেখি , গোপীনাথ মন্দিরের দ্বিতীয় পুরানো সংষ্করন থেকে একটা বিশেষ সরীসৃপ আমাদের খেলার জায়গার দিকে আসছে। ওটা আর কিছুই নয়, ওটা – দেড় হাত লম্বা একটা সাপ। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলাম। সকলেরই দৃষ্টি ওই সাপটার দিকে। একি, সাপটা যে আমার দিকেই আসছে। হঠাৎই, শুভ আমার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠল, “ব্যাটে করে সাপটার মাথা থেকে পাঁচ আঙ্গুল তলায় চাপ দিয়ে ধর। আমি সাপটাকে ধরবই। ”  শুভ আবার চেঁচিয়ে উঠল, “ ধর রে...”  শুভর কণ্ঠস্বর শুনে যেন আমার সম্বিত ফিরে এল। সামনে তাকিয়েই চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি – সাপটা আমার পায়ের ঠিক দুহাত দূরে। মনে যেন কোথা থেকে বল ফিরে এল। লাফিয়ে পাশের দিকে সরে গেলাম। তারপর ব্যাটে করে সাপটার পেটে সজোরে এক ঘা দিলাম। সাপটা একটু ছটকে উঠল। তারপর, যেন এক নৃশংস পাশবিকতার ভৃত্য হয়ে, সাপটার মাথা থেকে পাঁচ আঙ্গুল তলায় সজোরে চেপে ধরলাম। তারপর ভয়মিশ্রিত আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলাম , “পেরেছি রে... শুভ আয়, সাপটা ধরবি যে? তাড়াতাড়ি আয়।” শুভ বলল, “এক মিনিট অপেক্ষা কর।” তারপর দেখি- শুভ দূর থেকে একটা এক হাত লম্বা ও আধ হাত চওড়া সাদা পলিথিন কুড়িয়ে নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে। কাছে এসে পলিথিনের মুখটা সাপের মুখের কাছে ধরল। সাপটা লাফাতে লাফাতে মুখটা পলিথিনের ভিতর ঢোকাল। আর, আমি ব্যাটটা তুলে নিতেই সাপের পুরো দেহ পলিথিনে প্রবেশ করল। শুভ তখন পলিথিনের মুখটা একটা সুতো দিয়ে বেঁধে দিল । তারপর আমরা আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে চললাম।

দোলতলায় রামদার পাঁচ বছরের ছেলেটা আমার উদ্দেশ্যে বলল, “ভাই তুই ধরেছিস?” আমি বললাম, “এই আমরাই, আর কি...” এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে অত ছোটো ছেলেটা আমাকে ভাই বলে ডাকল কেন? আরে না,না আমি ওর ভাই নয়।  আমি তো ওর থেকে বয়সে প্রায় বছর আটেক-এর বড়। আসলে পাশের বাড়ির সুমন ছোটোবেলা থেকেই আমাকে আদর করে ভাই বলে ডাকে। আর সেই থেকেই কিভাবে জানিনা পাড়ার সবাই - কাকা থেকে কাকীমা, ছোটোরা- বড়রা সবাই আমায় ভাই বলে ডাকে। যেন ভাই আমার নাম!

                   বাড়ির সামনে আমরা উপস্থিত হলাম। দেখি, গুরুদাদু আর আমার বাবা বিষ্ফোরিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সাপের পলিথিনটা শুভর হাতেই ছিল। গুরুদাদু বললেন, “শুভ।আবার দুষ্টুমি!!” শুভ যেন সাহসের সঙ্গে দাদুর কথা কেটে দিয়ে বলল, “ বাবা – দাদাকে দেখাব বলে ধরলাম। দাদা আমার সাহস দেখে প্রশংসা করবে।” গুরুদাদুতো রেগে বকুনি দিলেন। বকা খওয়ার পর ঠিক হল সাপটিকে বড় পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমাদের বাড়ি থেকে চয়নদের বাড়ি যেতে মাঝে পুকুর পড়ে। সেই পুকুরের উত্তর পাড়েই আমরা দাঁড়িয়ে – ওটাই রাস্তা। তার উত্তরেই বড় পুকুর। অর্থাৎ, বলা যায় আমরা বড় পুকুরের দক্ষিনপাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। সাপসমেত পলিথিনটা বড়পুকুরে ফেলে দেওয়া হল। ঐ সময় পলিথিনের মুখের দড়িটা খোলার সাহস কারও ছিল না। বিকাল চার’টায় খেলতে যাওয়ার সময় ঠিক করে, যে যার বাড়ি চলে গেলাম।

          দুপুরে স্নান- খাওয়ার পর একাই মাঝের ঘরের মেঝেতে শুয়ে রইলাম। অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটে, তখন সাপ নিয়ে একটা অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। সাদা-কালো টিভিতেই যেন ভেসে উঠল – আমাদের ধরা সেই সাপটার ছবি। হঠাৎ চমকে উঠলাম। কারেন্ট-ও অফ হয়ে গেল। টিভি অফ করে সুয়ে পড়লাম। দেখলাম অনিকদাদা পাশে এসে সুয়ে পড়ল। আমি মনে মনে ভাবলাম – সত্যি সাপটাকে এভাবে কষ্ট দেওয়া উচিত হয়নি। আর, ওভাবে ফেলে আসাও উচিত হয়নি। বিকালে অবশ্যই, পলিথিনটা ছিঁড়ে সাপটাকে মুক্তি দেব। মনে মনে এই শপথ নিয়ে চোখ বুজলাম।

                   চোখ খুলতেই চোখ ঘড়িতে পড়ল। দেখি সারে চারটে বাজে।  অনিকদাদাকে ডেকে সাড়া না পাওয়ায়, একাই বেড় হলাম। বড়পুকুরের পাড়ে এসে দেখি, সাপ্টা মড়ে পড়ে আছে। মনটা দুক্ষঃ পেল। হরি ও চয়নের ঝাড় খাওয়া থেকে বাঁচতে আমি তাড়াতাড়ি ওপাড়ার দিকে রওনা দিলাম। পুকুরপাড়ের শেষটা ঢালু হয়ে রাস্তায় মিশেছে। এই জায়গাটাকে ঢিবিতলা বা ঢিপতলা বলে। ঢিপতলার কাছে এসে যা দেখলাম, তাতে রক্ত হিম হয়ে গেল, আর হৃৎস্পন্ধন যেন বন্ধ হয়ে গেল। দেখি সামনে তিনটি জাত সাপ ফনা তুলে আমার প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করেছে। আমি চমকে উঠলাম । আমার মাথা ঘুরতে লাগলো , আমার দৃষ্টি যেন আবছা হয়ে আসছে। মনে হল, সাপকে নিয়ে খেলাটা আমার উচিৎ হয়নি। এবার’কি সর্পাঘাতেই আমার সম্বিত ফিরবে। আর, সম্বিত ফিরেই হবেটা কি , কারন এই জাত সাপ যদি আমায় কামরায় তাহলে তো আমার বাঁচার সুযোগ আর নেই বললেই চলে। হঠাত পিছনে তাকিয়ে দেখি আরও দুটো জাত সাপ আমার দিকে ফনা তুলে ফোঁস ফোঁস করছে। সাত ফুটের মধ্যে পাঁচটা সাপের ফোঁসফোঁস আওয়াজ যেন আমার মৃত্যুবার্তা বয়ে আনছে। হঠাত সাপগুলোর ফোঁস ফোঁস আওয়াজের মানে যেন আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। তারা যেন বলছে, “আমরা তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি, তোমরা তাহলে কেন আমাদের একজনকে হত্যা করলে? এই হত্যার শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে। আমরা তোমাদেরকে ছাড়বনা।” হঠাতই একটা সাপ আমার পায়ের উপর ছোবোল বসালো। যন্ত্রনায় সারা শরীর কেঁপে উথল। আমি পা’টাকে ছিটকে নিলাম।

          হঠাৎ শুনি কাঁচভাঙ্গার শব্দ। এবার সত্যিই আমার সম্বিত ফিরে এল। দেখি আমি মাঝের ঘরের মেঝেতেই শুয়ে আছি, আর স্বপ্নের ঘোরে পায়ের কাছে রাখা হ্যারিকেন-এ লাথি মেরেছি । খুবই গভীরভাবে অনুভব করলাম আমার সত্যিই সম্বিত ফিরেছে। এই ধরনের কাজ আর নয়। তারপর আনিকদাদাকে নিয়ে বাইরে বের হলাম। দেখলাম বড়পুকুরের পারে সাপটা পলিথিনের মধ্যে মৃত আবস্থায় পড়ে আছে।  সুমন ওটাকে পোড়ানোর জন্য নিয়ে গেলো। আমি অনিকদাদাকে বললাম, “তাড়াতাড়ি চল , না’হলে হরিরা খেপে যাবে। ”

 

          তারপর,  ঢিপতলার দিকে পা বাড়াতেই বুকটা ধরাস করে উঠল ...