তিরিশ গ্রামের গুপ্তধন (দ্বিতীয় পর্ব) - Sarthak Goswami
আমি মনে মনে বললাম, “শীতভোরে বৃষ্টি ! তাহলে কি হরির কথামত অলৌকিক শক্তি বা যার গুপ্তধন সে আমাদের এই উদ্দোগে খুশি নয়? না হলে, মন্দির পুরানো হলেও পরিষ্কার তো – সাপ কেনো এলো? শীতের সকালে বৃষ্টি কেন আরম্ভ হল।” তারপরে মনে সাহস এনে নিজেকেই বললাম, “পরিষ্কার বাড়িতে সাপ যদি আসতে পারে তবে পোড়ো মন্দিরে সাপ আসা অলৌকিক নয়। আর, মৌসুমী জলবায়ুতে মাঝেমধ্যে বৃষ্টি ভৌগোলিক তবু অলৌকিক নয়। তাছাড়া, গোপীনাথকে তো বলেছি অর্ধেক ভাগ দেবোই।” তারপর, মনে উদ্দম নিয়ে এগিয়ে চললাম। চয়ন’কে ডাকলাম। নির্নেয় স্থানে গিয়ে দেখি হরিও উপস্থিত। হালকা বৃষ্টির সাথেই কাজের তোড়জোড় শুরু হল। কোদালটা নিয়ে মাটিতে মারতেই হঠাৎ বজ্রপাতের সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। সবাই ভয় পেয়ে দূর্গাদালানে গিয়ে উঠলাম। আমি যুক্তি দিয়ে সবার ভয় কাটালাম। মিনিট দশেক বাদেই বৃষ্টি থেমে গেল। আমরাও মহাসমারোহে কাজে লেগে পড়লাম। তারপর নির্নেয় স্থানে গিয়ে গর্ত খুলতে লাগলাম। ফুট-তিনেক গর্ত খুঁড়তেই একটা শক্তমত কি আমার কোদালে ঠেকলো।
আমি চারপাশটা খুঁড়তে লাগলাম ও বললাম, “এটাকে অক্ষত রাখতেই হবে।” তারপর সেই চকচকে জিনিসটাকে হাতে তুলে নিয়ে চয়ন বলল, “এটা তিরিশ গ্রাম হবেই।” জিনিসটা শক্ত চকচকে সোনালী। তারপর, কোদালে আর একটা কোপ দিতেই একটা হাড় বেড় হল। আমি হাতে তুলে বললাম, “হাড়টা কি সোনার? একটু ঘসে দেখি। ” কোদাল নিয়ে হাড়টা ঘসতেই অবাক হয়ে গেলাম। গর্ত থেকে ধোঁয়ার মত বেড় হতে থাকল। ক্রমশ ধোঁয়াটা একটা একমাত্রিক কুয়াশামানবের রূপ নিল। সব দেখে চয়ন আর হরি অজ্ঞান হয়ে গেল।
আমি কোনোক্রমে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে রইলাম। কুয়াশামানব তো একমাত্রিক, ধোঁয়ার আস্তরনের মত দাঁড়িয়ে আছে। উচ্চতা প্রায় ৫ ফুট ২ ইঞ্চি।
চোখগুলো হলুদ। দুহাতে বড় বড় নখ। সারা গায়ে আলখাল্লার মত পোষাক। দেখলেই, শরীর শিউরে ওঠে।
ইতিমধ্যে মুসলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হঠাৎ কুয়াশামানবের রাগি ক্ষনা কন্ঠ থেকে একটা তীব্র আওয়াজ বেড়িয়ে এল। কুয়াশামানব বলল, “এখানে কেন?”
আমি ভীত কন্ঠে বললাম, “আপনি কে?”
কুয়াশা মানব বলল , “আমি এই সোয়ালুক গ্রামের জমিদার। শুধু তাই নয় আমি আকবরের সভায় সভাসদ ছিলাম। তবে জমিদার বলে কোনোদিন কাউকে অত্যাচার করিনি।আমি ছিলাম যথেষ্ট সৎ। হঠাৎ, এক বিদেশি গুপ্তচর আমায় হত্যা করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। আমার সৎকার পর্যন্ত করেনি।তাই আমি আমার সমস্ত ধনসম্পদ আমি নিজেই আগলে রাখি। আমার কষ্টের ধনসম্পদ আমি কাউকে পেতে দেবোনা। তুমি এই ধনসম্পদ নিতে পারবে না।”
আপনি বাঁচলে গুপ্তধনের নাম। প্রবাদটা বোধহয় মাথা থেকে চলে গিয়েছিল।
তবু আমি বলে উঠলাম, “তবু,এত কষ্ট করে উদ্ধার করলাম। কচিবুদ্ধির ফলস্বরূপ তো আপনিই পুরষ্কার দিতে পারেন।”
কুয়াশা মানব আবার রেগে চেঁচিয়ে উঠল, “পুরষ্কার? আমি এত সৎ - কি পুরষ্কার পেলাম? জীবনটা গেল।
শুধু এই গ্রামে নয় আশেপাশের তিরিশটা গ্রামে আমার গুপ্তধন আছে। আর এই সব গুপ্তধন কেউ পাবে না। আমি নিতে দেবো না। এই তিরিশ গ্রামের গুপ্তধনের মালিক আমি একা। আমি একা। আর কেউ এই তিরিশ গ্রামের গুপ্তধনের ভাগ পাবে না। আমি পেতে দেব না।”
আমার হাত থেকে ইতিমধ্যে কোদাল পরে গিয়েছে।
হঠাৎ, কুয়াশামানব তারহাততুলে আমার মাথায় সজোরে মারলো এক ঘা।
আমার মাথা ঘুরে গেল।আছড়ে পড়লাম মাটিতে।
আমার চেনা পৃথিবীটা, আমার কাছে হঠাৎ যেন অন্ধকার হয়ে গেল। আমার দেহের সমস্ত শক্তি যেন দেহ থেকে বেড়িয়ে গেল। তবু এটুকু আশা – শরীরে প্রানটা আছে।
চোখ চাওয়ার চেষ্টা করলেও কষ্টে চোখ বুজে গেল।
চোখ চাইলাম হঠাৎ একটা শব্দে। শব্দটা খুব চেনা। শব্দ নয় যেন শব্দঝুড়ি অর্থাৎ একগুচ্ছ শব্দ। কন্ঠস্বরটাও চেনা। এ যে মায়ের কন্ঠস্বর। মা চেঁচাচ্ছে। বলছে, “ছুটতে যাওয়ার জন্য ভোরে ডাকলাম।উঠলি না। বেলা সাতটা বাজল। এবার তো ওঠ্। আমাকে বিছানা গুছাতে হবে।” এই বলে মা আমায় নাড়া দিয়ে জাগিয়ে দিল।
আমার সম্বিত ফিরে এল। বুঝলাম, সকালে বৃষ্টিও হয়নি আর আমি ওপাড়া - দোলতলা কোথাও যাইনি। সবই স্বপ্নে ঘটেছে। ইতিমধ্যে, চয়ন ও হরি বাড়িতে এসেছে।
চয়ন বলল, “তুই যাসনি, তাই আমরা আর কাজ শুরু করিনি।” আমি আমার স্বপ্নের কথা জানিয়েই ক্ষান্ত হলাম না।
আমি বললাম, “আজ বিকালে ওইখানটায় গর্ত খুঁড়তে হবে। একটু সন্ধ্যা করে। কারন – ওই সময়টায় ওখানে কেউ যায় না। তাছাড়া, অয়ন-সায়ন মাসীরবাড়ি গেছে। তাই, বাড়তি উৎপাতটাও থাকবে না।”
পুর্বপরিকল্পিতভাবে কাজ আরম্ভ করার জন্যে রওনা দিলাম বিকালে। চয়নকে গর্ত খোঁড়ার দায়িত্ব দিয়ে আমরাদুজন পাশে এসে দাঁড়ালাম।
কিছুক্ষন পর চয়ন বলল, “আমি তো ফুট-দুয়েক কাজ করলাম , এবার তোরা কেউ দে। ”
আমি বললাম, “দাঁড়া একটু, যাচ্ছি।”
তারপর দেখি চয়ন কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে গর্তের দিকে চেয়ে রয়েছে। কোদালটা মাঠের উপর রেখে, গর্তের ভিতর ঝুঁকে পড়েছে। তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ সত্যিই রে, অন্তত তিরিশ গ্রাম হবেই। ”
আমি বললাম, “কি? কোনটা তিরিশ গ্রাম?”
চয়ন গর্তের দিকে হাত দেখিয়ে বলল, “এই যে এইটা!”
মনটা যেন অজানা কোনো আনন্দে ভরে গেল। হাতটা মুঠো করে হাতের উপর জোড়ে চাপ দিলাম। যেন জিতে গেছি। আমি বিস্মিত হয়ে মনে মনে বললাম – আমার গননা এত নিখুঁত হতে পারে? দুজনে গর্তের দিকে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে যা দেখলাম, তাতে মাথা নুইয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। যা দেখলাম তা আমাদের তো বটেই আপনাদেরও অনেকেরই চেনা। জিনিসটা সত্যই প্রায় তিরিশ গ্রাম হবে। জিনিস্টা আর কিছুই নয় - হারিয়ে যাওয়া পুরানো প্লাস্টিক ক্রিকেট বল।
আমরা ৩৫ গ্রাম প্লাস্টিক বলে খেলতাম।বলটা খেলে খেলে হালকা হলেও প্রায় তিরিশ গ্রামে দাঁড়িয়েছিল।
আর, ওই লাল বলটা নিয়েই কিশোর সংঘের বড় মাঠে একদিনের ক্রিকেট ফাইনাল খেলা হয়েছিল। তাতে ফাইনালে উঠেছিল, আমাদেরই দল সোয়ালুক কিশোর সংঘ। সেদিন জিততে আমাদের শেষ বলে ছয় রান দরকার ছিল। আর, তা আমরা শেষ বলে ছয় দিয়েই শেষ করি। তখন বলটা পড়েছিল দুর্গাদালানের পিছনে, বটতলার দক্ষিনে জলহরি নামক পানা পুকুরে। তাই বলটা আমরা সবাই চাইলেও কেও খুঁজে পাইনি। তারপর, বিশাল বান আসে আর ওই বলের পলিসমাধি ঘটে আমাদেরই এই ক্রিকেট মাঠে। সেদিন বলটা উদ্ধার করে তিনজন মহা আনন্দে বাড়ি গেলাম।
এই ঘটনার কয়েকদিন পরে, ওই বলের তৎকালীন বাজারমূল্যের অর্ধেক, অর্থাৎ ছয় টাকার অর্ধেক তিন টাকা - পুর্বকথামত তিনজনে এসে গোপীনাথকে দিয়েছিলাম।
বলটা বর্তমানে, দুর্গামন্দিরের পশ্চিমে অর্থাৎ বড় মাঠের পুর্বে আমাদের ক্লাবঘরের ভিতর একটি কাঁচের বাক্সতে প্লাস্টিকের মালা পরিহিত অবস্থায় অবস্থান করছে।
সবার কাছে ওই বল ক্লাবের ট্রফিজয়ের স্মৃতিস্বরূপ রূপে বিরাজ করলেও, আমাদের তিনজনের কাছে তা গুপ্তধন খোঁজার প্রতীকরূপে বিরাজিত।
এখন মনে প্রশ্ন জাগে – নির্নেয় স্থানের দশ পনেরো ফুট তলায় সত্যই কি গুপ্তধন বর্তমান! এর উত্তর সকলেরই অজানা। পরক্ষনেই মঙ্কে সান্ত্বনা দিই গুপ্তধন কি শুধুই লুকিয়ে থাকা বহুমূল্য ধন। গুপ্তধন হল মানব মনে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত মানব চেতনা। তাই গুপ্তধন খোঁজা কোনো খারাপ কাজ নয়। এর মাধ্যমে সুপ্ত মানব চেতনা ও বুদ্ধির উন্মেষ হয়। তাছাড়া, যা পেয়েছি তা তো কম কিছু নয়। তা আমাদের ক্লাবের চিরকালের সম্মানের বস্তু। শুধু তাইই নয় – ওই মহামূল্য তিরিশ গ্রামের গুপ্তধনের তলায় ধন্যবাদের সঙ্গে আমাদের তিনজনের নাম লেখা আছে। যা, আজও আমাদের উৎসাহ দিয়ে যায় – নতুন কিছু করতে।
সম্প্রতি অনিকদাদা আমাদের বাড়িতে এসেছিল। হঠাৎ আমায় জিজ্ঞাসা করে বসল, “তাহলে গুপ্তধন পাওয়া গেল! কি বল ?”
আমি বললাম, “গুপ্তধন! – তিরিশ গ্রামের গুপ্তধন।।”
অনিকদাদা বলল, “আর ?”
আমি বললাম , “ দেখতে হবে.........”