বিগত দশ বছর ধরে আমরা বিরাজমান। কিছু প্রউক্তুশিল কারণে আমাদের মেইন ওয়েবসাইটটি কিছুদিন বন্ধ ছিল। আমাদের কাজ চলছে, আমরা আবার আসিব ফিরে। কিন্তু ততদিন আমাদের এতদিনের আর্কাইভটা প্রকাশ করা থাকল। অনেক পুরনো জিনিসপত্র পাবেন, যদি কারর কন আপত্তি থাকে আমাদের কে মেইল করে জানাবেন। admin@werbangali.com
আপনি যদি আমাদের e-commerce shop খুজ্জেন তাহলে এই লিঙ্ক এ ভিজিট করুন : shop.werbangali.com

তিরিশ গ্রামের গুপ্তধন (প্রথম পর্ব) - Sarthak Goswami

কালটা বোধহয় শীতকাল।

কারন, তখন সকালে সবার গায়ে চাদর ও মাথায় মাফলার এবং আমার সারা দেহে ঘাম দেখতে পেতাম। শুনতে অবাক লাগলেও, কথাটা সত্য। কারন- তখন ভোরে উঠে পাড়ায় ছুটতে বের হওয়া আমার নিত্য অভ্যাস –এ পরিনত হয়েছিল। তাই, প্রবল শীতেও আমার শরীরচর্চার ফলস্বরূপ, আমার সারা দেহ ঘেমে উঠত।

       কালটা যে শীতকাল, তা এই কারনেই মনে হয় যে, তখনকার সকালে ঘাসের ডগে যে শিশির জমত এবং দৌড়ে এসে যে চা খেতাম তা স্পষ্ট মনে পরে। চা খাওয়ার কথা এই কারনেই বললাম যে, আমি সাধারনত, শীতের সকাল ছাড়া চা খাওয়াটা মোতেও পছন্দ করতাম না। তাই, কালটা শীতকাল না হলেও, তখন শীতের রেস ভালোই ছিল। তাই, সময়টা হেমন্তের শেষ অথবা বসন্তর শুরু হতে পারে।

       শীতকালে পরীক্ষার চাপ কম থাকত বলেই বোধহয় খেলাধুলাটা একটু বেশিই হত। শীতকালে যে খেলাটা আমাদের মাঠে বেশি হত সেটা ক্রিকেট, আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা। তাবলে, এটা বলছি না যে আমি ফুটবল ভালোবাসি না, গ্রীষ্মকালের বেশিরভাগ সময়ই ফুটবলের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত হত।

তাছাড়াও মাঝে মাঝে হুচুকে পড়ে বুড়ি-বসন্ত, লুকোচুরি,পাঁচ-হাততালি, চার-হাততালির মত মজাদার খেলাও চলত।

সকলেই কম বেশি মাঠে উপস্থিত থাকত, তবে যে তিনজন  প্রতিদিন খেলার স্বাদগ্রহন করতাম – তারা হল আমি,চয়ন,হরি। আমাদের বাড়ি থেকে খেলতে যেতে প্রথমেই চয়নের বাড়ি।

চয়ন অর্থাৎ চয়ন গোস্বামী, ওবাড়ির মেজদার ছেলে। সম্পর্কে আমার ভাইপো হলেও, আমার এক ক্লাস নীচে পড়াশুনা করলেও, ও আমার নাম ধরে ডাকত। হরির বাড়ি, খেলার মাঠের কাছেই।হরি অর্থাৎ প্রিয়ব্রত গোস্বামী, ওপাড়ায় বাসরত দীলিপ কাকুর ছেলে।সম্পর্কে আমার খুরতুতো ভাই। এক ক্লাসে পড়তাম, তাই দুজনে বন্ধুর মত থাকতাম, দুজনেই দুজনকে নাম ধরে ডাকতাম।

              আমাদের বাড়ির পাশের পুকুরের পশ্চিম ধারে চয়নদের বাড়ি, যেটাকে আমরা সাধারনত ওবাড়ি বলি। ওবাড়ির পশ্চিমে একটু ছেড়েই গোপীনাথের দোল মন্দির। তার দক্ষিন-পশ্চিমে বটগাছটা পের হলেই আমাদের সোয়ালুক কিশোর সংঘ ক্লাবের, বিশাল বড় মাঠ। মাঠের দক্ষিন-পুর্ব কোনের পুর্বেই আমাদের দূর্গামন্দির। দূর্গামন্দিরের দক্ষিনে মাঝারি আকারের জায়গা, যেটা আমাদের খেলার জায়গা ছিল। খেলার মাঠটার দক্ষিনে দুটি মন্দির- পুর্বপার্শ্বেরটা আমাদের আরাধ্য দেবতা গোপীনাথ-রাধারানির নুতন মন্দির। আর, পশ্চিমপার্শ্বেরটা গোপীনাথ-রাধারানিরই পুরানো টেরাকোটার কাজ করা পুরানো দ্বিতীয় মন্দির। নতুন মন্দিরের দক্ষিনে নাট্যমন্দির। নাট্যমন্দিরের পশ্চিমপার্শ্বে ছোটোদের একটু খেলার জায়গার পাশেই হরিদের বাড়ি। দোলমন্দিরের আশেপাশের জায়গাকে দোলতলা এবং বটগাছের পাশের রাস্তা থেকে হরিদের বাড়ির পর পর্যন্ত জায়গাকে আমরা ওপাড়া বলতাম।

                     দিনটা ছিল শুক্রবার। সময় প্রায় বিকাল চারটে। নেশামত ওই সময় দূর্গাদালানের সামনে আমরা তিনজন বল, ব্যাট উইকেট নিয়ে হাজির হলাম। পিচে জল দিয়ে উইকেট পুঁততে যাব, এমন সময় হাজির অয়ন আর সায়ন – চয়নের থেকে বছর তিনেক এর ছোটো ওর দুই যমজ ভাই।বলে, তারাও খেলবে। আমি আর হরি যুক্তি করে বললাম , “ নিয়ে নে”।

 

খেলা শুরু হল।

মেজদা দেখলাম দূর্গাদালানে এসে বসেছে। মহাসমারোহে খেলা চলতে থাকলো। আমি ব্যাট করছি আর চয়ন বল করছে, বাকিরা ফিল্ডিং করছে। হঠাৎ এরকম একটা ঘটে যাবে বুঝতে পারিনি। তবে যেটা হওয়ার, সেটা তো আর আটকানো যায় না। তবে ঘটনাটা খুলেই বলি –

                                  হঠাৎ, বলটা মাড়লাম অয়নের ডানপায়ের হাঁটুর নীচে। তাকিয়ে দেখি সেখানে একটা কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা আছে, হয়তো পুরানো চোট।আমরা খেলতাম শক্ত প্লাস্টিক বলে। তাই, ওর পা’টা হঠাৎ ফুলে গেল। ছুটে গিয়ে দূর্গামন্দিরের পুর্বদিকের কল থেকে জল এনে অয়নের পা মালিশ করতে লাগলাম। ওতো, যন্ত্রনাতে ছটফট করতে লাগলো। মেজদা এগিয়ে এলো। দেখলাম মেজদা রেগে গেছে।

 মেজদা রেগে গিয়ে বলল, “এই সব খেলা বন্ধ কর। এতো শক্ত বলে কেউ খেলে?”

আমি বললাম, “বল কি বীরেন্দ্র সেহবাগ খেলে।”

মেজদা আর আমার বাক্যালাপ চলতে লাগল-

মেজদা বলল, “আরে ও গুলো কাঠ ডিউস বল।”

-     না, গো আমি আসল খেলার কথা বলছি না। আমি বলছি প্র্যাকটিস করার কথা।

-     ধুর, তুই আর বকিস না। ওরা সবাই কাঠ ডিউস বলে প্র্যাকটিস করে।

-     না গো, আমি কাগজে পড়েছি যে, সেহবাগ নিজের কোচের কাছে সিমেন্টের পিচে, প্লাস্টিক বলে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করে।

-     তোদের, আর সেহবাগ হতে হবে না। মন দিয়ে পড়। তাহলেই হবে।

ততক্ষনে দেখলাম, অয়ন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়েছে।

মেজদা বলল, “আজ যখন এ রকম একটা হয়েছে, আজ আর খেলিস না।”

মেজদার সঙ্গে তর্ক করলেও মেজদার কথা ফেলার মতো স্পর্ধা আমাদের কারও ছিলনা । তাই, মেজদাই সেদিনের খেলার ইতি টানলো।

                     পরদিন শনিবার। সময় সেই প্রায় বিকাল চারটা। স্থান ওই একই মাঠ। গতকালের পাঁচজনই হাজির হলাম খেলতে।

আমি বললাম, “কাল যখন ওরকম একটা হল ! আজকে ক্রিকেটা না হয় থাক।”  

চয়ন ও অয়ন একসঙ্গে গর্জে উঠলো, “আজ তো আর বাবা নেই।”

আমি বললাম, “ক্রিকেট ছাড়া কি আর খেলা নেই ? একদিন না হয় অন্য কিছুই খেললি ।”

শেষে সবাই রাজি হল এবং সিদ্ধান্ত হল যে, লুকোচুরি খেলা হবে। আমার এই সিদ্ধান্তই বোধহয় আমাকে সেই রোমাঞ্চকর স্মৃতির সাক্ষী করেছিল। মহা উদ্দোমেই খেলা শুরু হল। প্রথমে সায়ন চোর হল। আমরা যে যার জায়গায় লুকিয়ে পরলাম। প্রথমেই চয়নকে শনাক্ত করে এক বলল। তখন চয়নকে চোর হতে বাঁচানোর জন্য আমার আর হরির উপর চাপ পড়ল। আমি ও হরি এককাছেই ছিলাম। আমি বললাম, “চয়নকে বাঁচাতেই হবে। চল আমরা দুজন গোপীনাথের পুরানো মন্দিরে যাই। ওখানে ভালোভাবে খোঁজার সাহস বোধহয় সায়নের হবে না। আর, এলেও আমরা ওকে ধপ্‌ দিতে পারবো।” হরি ভয় খেয়ে বলল, “না বাবা। ওই পুরানো মন্দিরে? আমি যাচ্ছি না। তাতে চয়ন চোর খাটুক – আমার কিছু এসে যায় না। তাছাড়া আমি এখান থেকেই চেষ্টা করছি। অসুবিধা কি আছে? ”

 এক্ষেত্রে একটা কথা জানিয়ে রাখি-

হরির আপত্তি অস্বাভাবিক নয়। আসলে ব্যাপারটা হল - গোপীনাথের পুরানো মন্দির মানে সত্যিই পোড়ো মন্দির ছিল।‘ছিল’- এই কারনেই বলছি যে- তখন ওই মন্দিরের গায়ে বনগাছে ভর্তি ছিল। আর ভিতর ছিল, স্যাঁতস্যাঁতে। যে কোনো বিশাক্ত পোকামাকড় থাকা অস্বাভাবিক নয়। যদিও, পরে সরকারি আনুকুল্যে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়। আর, বর্তমানে স্থানীয় উদ্যোগেতো মন্দিরটি অন্য রূপ পেয়েছে।

প্রাচীন বাঁকানো সিঁড়ি দেখার লোকের অভাব আর এখন নেই। টেরাকোটার কাজ সমেত পঞ্চচূড় মন্দিরটি এখন দেখলে চোখ ফেরানো যায় না।

      কিছুক্ষন তর্কবিতর্কের পর হরি রাজি হল। আমরা দুজনে গোপীনাথের পুরানো মন্দিরে গিয়ে ঢুকলাম। ছাদে ওঠার বাঁকানো প্রাচীন সিঁড়িটাতে দুজনে বসে, নীচে দরজার দিকে নজর রাখলাম। দেখলাম, দেওয়ালের গায়ে টেরাকোটার কাজ ভগ্ন হলেও, অল্প হলেও – স্বল্প আলোতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিছুটা দূরে টেরাকোটার কাজগুলো শেষ হলেও, সামনের মাথার কিছুটা উপরের ছবিটা আমার দৃষ্টি আকর্ষন করল। আমি কিছুক্ষন ওই টেরাকোটার কাজটার দিকে দেখে, হরিকে বললাম, “পেয়েছি। পেয়েছি।গুপ্তধনের হদিশ। ” হরি বিরক্তি প্রকাশ করল। কারন একটাই – ও সব ব্যাপারে আমাকে সমর্থন করলেও, এই একটি নেশার ক্ষেত্রে, ও আমায় কোনোদিনই সমর্থন করেনা – সেটা হল গুপ্তধনের নেশা।বলা ভালো গুপ্তধন খোঁজার নেশা। এই নেশা আমার একারই নেই , আছে অনিকদাদারও। অনিক হালদার, মেজমামার ছেলে, অর্থাৎ আমার চেয়ে মাত্র এক বছরের বড়, একমাত্র মামাতো দাদা। ও নামেই দাদা – আসলে আমরা বন্ধুর মতো। অনিকদাদা মাঝেমাঝেই আমাদের বাড়ি অর্থাৎ ওর একমাত্র পিসিরবাড়ি আসে। আর, আমাদের গুপ্তধন খোঁজার নেশাতে সাক্ষী থাকে হরি ও চয়ন। আর – প্রতিবারেই আমরা ব্যর্থ। তাই, ওরা তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে – আমাদের এই বাজে নেশার ব্যাপারে।

                     আমাদের গুপ্তধন খোঁজা, গুপ্তধন পেয়ে রাতারাতি বড়োলোক হওয়ার জন্য নয়। এই অভ্যাস, অনুসন্ধিৎসু কিশোর মনের সুস্পষ্ট প্রকাশ মাত্র। একবারতো আমরা মামারবাড়িতে গুপ্তধনের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম । যদিও পুরো কৃতিত্বটা অনিকদাদারই প্রাপ্য। মামারবাড়ি প্রাচীন কালের দুতলা বাড়ি। দেওয়াল তিরিশ ইঞ্চি চওড়া। তাই তার মধ্যে গুপ্তধন থাকতেই পারে। খেয়াল করলাম, প্রতিটা ঘরেই দরজার মাথায় কুলুঙ্গি অর্থাৎ বড় মাপের তাক বা গর্ত আছে। শুধু পশ্চিমের উপরের ঘরে নেই।

তাই ভাবলাম ওই জায়গায় গুপ্তধন আছে। তৎক্ষণাৎ কথাটা মেজমামাকে জানালাম। মেজমামাতো হাসতে লাগলো। তারপর বলল, “ওখানে কুলুঙ্গি ছিল। ঘরটা পরে থাকতো বলে মৌমাছির চাক হত। তাই, আমিই কয়েক বছর আগে রাজমিস্ত্রি ডেকে ওটা বোজানোর ব্যবস্থা করি।” এবারও আমারা ব্যর্থ।

              এসব কথা মনে পড়লেও এখনও আমি সেই পোড়ো মন্দিরে, ওই গুপ্তধনের হদিশচিত্রের সমাধানের চেষ্টায় চিন্তিত। তারপর, বেড়িয়ে সয়নকে ধপ্‌ দিয়ে চয়নকে বাঁচালাম। তখন, সকাল সকালই খেলায় ইতি টানলাম। তারপর জোর করেই অয়ন ও সায়নকে বাড়ি পাঠালাম। চয়ন কিছু বুঝতে না পারলেও,আমাকে বাধা দেয়নি। তারপর চয়নকে বললাম, “ একটা গুপ্তধনের উৎস সমাধান করতে হবে, মন্দিরের ভিতর সংকেত পেয়েছি। ” চয়ন রেগে বলল, “সবাই যদি সব করত, তাহলে দ্রৌপদীও তীর চালাত।” আমি বললাম, “এবারে নিশ্চিত পাব। তোর মনে হলে তোকে থাকতে হবে না।” চয়ন বলল,“চলতো দেখি! কোথায় কি ছবি দেখলি।” আসলে হুচুক আমার থাকলেও, চয়ন ও হরি সমান অনুসন্ধিৎসু ছিল। সিঁড়িতে গিয়ে ছবিটা ভালোভাবে দেখলাম। তারপর যেটা দেখলাম, সেটা দেখে রক্ত হিম হয়ে গেল। দেখলাম একটা সাপ, আর কয়েকটা সিঁড়ির উপর সুয়ে ফোঁস ফোঁস করছে। গ্রামের ছেলে হলেও স্বল্প আলোতে, ওটা যে কি সাপ তা অল্পও বুঝতে পারিনি। ছুটে বেড়িয়ে এলাম। তারপর তিনজনে মন্দিরের উত্তর দুয়ারে অর্থাৎ আমাদের খেলার মাঠের দিকের মন্দিরের দুয়ারে বসলাম। এবার যেন বুকে কিছুটা বল এল। হরি বলল, “গুপ্তধন হয়তো আছে। কিন্তু গোপীনাথ ঠাকুর হয়তো দিতে রাজি নয়। নাহলে এরকম একটা হল! ” যেহেতু আমি নাস্তিক নয়, আর খুবই ঠাকুর মানি, তাই কথাটা উড়িয়ে দিতে পারলাম না। আমি বললাম, “সেই রকমই যদি হয়, তবে আমি গোপীনাথকে কথা দিলাম, যদি গুপ্তধন পাই তবে, তার অর্ধেক বা অর্ধেক বাজারমূল্য আমি গোপীনাথকে অবশ্যই দেবো।” হরি সহমত হল।

চয়ন বলল, “আমিও সহমত। তবে গুপ্তধনের কোথায় কি? আগে তো গুপ্তধন পাই- তারপর নয় গুপ্তধনের বাকি অর্ধেক আমরা তিন জনে সমান ভাগে ভাগ করব। ”

 

              এবার ছবিটার বিবরন দেওয়া যাক। একটা বর্গক্ষেত্র, তার উপরে দুধারে দুটি ছোটো ত্রিভুজ ও মাঝখানে একটি বড় ত্রিভুজ।

আর, বর্গক্ষেত্রের তলাতেও একই ভাবে তিনটি ত্রিভুজ, তবে বড় ত্রিভুজটার মাথায় তারা চিহ্ন।

আর, উপরের বড় ত্রিভুজটার মাথায় কিছুটা ছেড়ে একটা বৃত্ত আঁকা আছে। আর একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় ছিল-সেটা হল, তলার তিনটি ত্রিভুজের গায়ে দাঁড়ি দাঁড়ি দাগ টানা আছে।

      ছবিটা সবাই ভেবে, তিনজনেই আলাদা আলাদা মত প্রকাশ করলাম। প্রথমে চয়ন বলল, “ এটা আর কিছুই নয়। প্রাচীন যুগের অনেক কিছুই তো টেরাকোটা  পরিবেশনা করে। প্রাচীন যুগেও যে জ্যামিতির প্রয়োগ হত, টেরাকোটাতে সেটাই বলছে। ” হরি চয়নকে থামিয়ে বলল, “না সেটা কি করে হয়। তাহলে, দাঁড়ি দাঁড়ি দাগের মানে কি? ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে ভাবতে হবে। আমরা ভুগোল বা বিজ্ঞানে দুটি স্তরকে আলাদা করে বোঝাতে, দাঁড়ি দাঁড়ি দিয়ে যে শেড দিই, এটা অনেকটা ওই রকম। তাহলে এটা ভাবতে হবে যে ‘শেড’-টা কি অর্থ বহন করছে। ” আমি বললাম, “ ঠিক বলেছিস। এটা তো জানিস যে, টেরাকোটাতে তৎকালীন সমাজজীবনের প্রতিফলন পাওয়া যায়। আমাদের আগে নির্নয় করতে হবে এই মন্দিরের স্থাপনকাল। জেঠুর মুখে শুনেছি, গোপীনাথের মন্দির প্রায় পাঁচশ বছরের পুরানো। আর, এই পুরানো মন্দির গোপীনাথের দ্বিতীয় মন্দির। তাহলে প্রথম মন্দির স্থাপিত হয়েছিল ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে। প্রথম মন্দির অর্থাৎ ভাঙ্গাকোঠা অতটা শক্তপোক্ত ছিল না। যার প্রমান স্বরূপ বলা যায় যে – এর বর্তমান অস্তিত্ব বলতে শুধু ভিতের কয়েকটা ইঁট। তাই, সেই মন্দির যে ১৫০ বা ২০০ বছর টিকেছিল তা বলা যায় না। আবার, যদি দ্বিতীয় মন্দির টেকেও – তবে তা নির্মিত হতে হবে শাহাজাহান বা ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে। আবার ইতিহাস থেকে জানা যায়, শাহাজাহান সারাজীবন ও ঔরঙ্গজেব প্রথম জীবনে হিন্দুবিরোধী ছিলেন। তাই, যদি ধরা হয় – প্রথম মন্দির ৭০ থেকে ৭৫ বছর টিকেছিল, তাহলে পুরো ব্যাপারটা মিলে যাচ্ছে। কারন- ১৫৭০ থেকে ১৫৭৫ খ্রীষ্টাব্দ আকবর রাজত্ব করছিলেন এবং এই সময় তিনি হিন্দুধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন, ইবাদৎখানা প্রতিষ্ঠার পর। তাছাড়া ফতেপুর সিক্রির   দেওয়ালে যে ভগবান, লতাপাতা, চারচৌকো ফুলের ও ধাপবিশিষ্ট গেটের ছবি     দেখা যায় তা আমাদের মন্দিরেও দেখা যায়।  তাই এটা হতেই পারে – তখনকার হিন্দু-মুসলমান সমন্বয়ের এটা একটা ছোট্ট নিদর্শন। ‘শেড’ ছাড়া অংশটা হিন্দুদের মন্দির আর, ‘শেড’ দেওয়া অংশটা মুসলিমদের মসজিদ। এমনকি, ওই তারা চিহ্নটাও মুসলিম সততার প্রতীক হিসাবে অবস্থান করছে।

দেখ আমি কদিন আগেই  ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে  অনুমান করছিলাম। আর দেখ মনে হচ্ছে এটা কাজে লাগবে। বই ঘাঁটাটা বিফলে যাবে না।”

সব শুনে চয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “তাহলে গুপ্তধনের প্রসঙ্গ তুললি কেন ?” আমি একটু থেমে বললাম, “তাহলে ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে ভাবতে হবে।”

              তিনজনেই ভাবতে লাগলাম। নির্জন এলাকার উত্তুরে ঠাণ্ডা বাতাস যেন দেহটাকে চাঙ্গা করে, মগজে বুদ্ধির সান্‌ দিয়ে যাচ্ছিল। অদুরে একটা গরু ডেকে উঠল। হঠাৎ চমকে গেলাম। তারপর একবার মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, “আচ্ছা, সামনের দিক থেকে তো মন্দিরের তিনটি চূড়া দেখা যায়। তাহলে, ‘শেড’ ছাড়া অংশটাকে যদি আমাদেরই পুরানো মন্দির ও বৃত্তটাকে চাঁদ ধরি, তবে ‘শেড’ দেওয়া অংশটা মন্দিরের ছায়া, আর তারা চিহ্ন অংশটা গুপ্তধন হতেই পারে। ” তখন হরি বলল, “অর্থাৎ পুর্নিমার দিন, মন্দিরের বড় চূড়ার ছায়া যেখানে শেষ – সেখানেই গুপ্তধন।” আমি বললাম, “ঠিক ধরেছিস।” চয়ন বলল, “পুর্নিমার দিন তো সময় বিশেষে ছায়া বিভিন্ন জায়গায় পড়বে। তাহলে কোন সময়টা ধরবি? ” আমি বললাম, “মন্দিরের সন্ধ্যাআরতির সময় অর্থাৎ সন্ধ্যা সাতটা। ” হরি বলল, “তারমানে – আমরা যেখানে খেলি, সেখানেই লুকিয়ে আছে গুপ্তধন। অবিশ্বাস্য।। ”

                     হরির বাড়ি কাছে বলে ঠিক হল- সন্ধ্যায় হরিই এসে নির্নেয় স্থানে একটা উইকেট গেঁথে দিয়ে যাবে।

 আর পড়দিন সকালে, আমরা তিনজন ছুটতে আসার নাম করে এই স্থানে আসব। হরিকে বলা হল কদাল আনতে। মাটি খোঁড়ার সমস্ত পরিকল্পনা প্রস্তুত। সবাই বাড়ি ফিরে গেলাম। রাত্রে আনন্দে সকাল সকাল শুয়ে পরলাম।

                       সকালে উঠলাম ঝুঁজকো অন্ধকার থাকতে। আলো ফুটতে তখনও দেড়ি।

মাকে বললাম, “মা ছুটতে যাচ্ছি।”

মা বলল, “এত সকালে? এখনও ত আলো ফোটেনি।”

-     তো কি হয়েছে? সবাই বলেছে আজ সকাল সকাল উঠবে।

-     ঠিক আছে যা। সাবধানে দৌড়াবি। রাস্তা দেখে যাবি।

বাইরেবেড়িয়ে দেখলাম আমার গায়ে দু-চার ফোঁটা জল পড়ল।