তা হ লে কি... (দ্বিতীয় পর্ব) - Sarthak Goswami
- তুই খুব ভালো রে। দেখবি তুই খুব উন্নতি করবি। অনেক বড় মানুষ হবি।
- তুমি পরে ঠিক আমার সঙ্গে দেখা করবে তো?
- ঠিক আছে। কথা দিলাম।।
- (বৃদ্ধের গায়ে হাত দিয়ে) এ কি তোমার গায়ে জ্বর যে। গা তো খুব গরম।
- ও তো মাঝেমাঝেই হয়।
- আমি তোমার জন্য ওষুধ আনি?
- না রে অতো ব্যস্ত হস্ না। আনতে হবে না।
- না গো ,ওই বাঁধের ধারে আমার বন্ধুর বাড়ি। ওর কাছ থেকে একটা ঔষধ এনে দিচ্ছি।
- ঠিক আছে আন্। আমি এইখানেই থাকব।
- আমি ৫ মিনিটের মধ্যেই আসছি।
- তুই আর একবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দে, আমার খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে যেন আমার কাছের মানুষ আমাকে আদর করছে।
- এই তো আমি দিচ্ছি।
- আঃ আঃ আঃ আঃ.........
- আমি এক্ষুনি আসছি...
এই বলে আমি সেখান থেকে চলে এলাম। ডুবন্ত সুর্য ততক্ষন ডুবে গেছে, শুধু ম্লান আলোকে দিনের শেষ বিদায় জানাচ্ছে। পাখিরা দলে দলে বাসায় ফিরছে। আমার বাড়ি ফেরার চিন্তা তখন মাথা থেকে উড়ে গিয়েছে। বৃদ্ধের করুন মুখের শেষ আকুতিগুলো মনকে বিসন্ন করে রেখেছে। অবাক হয়ে নির্মল আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি, বৃদ্ধ যেন এই আকাশের মতই উদার। - কোনও কষ্ট নেই, অতি সুন্দর... কিন্তু ভিতরের মেঘের খবরই বা কে রেখে, আর বজ্রপাতে হৃদয় ভাঙার কথাই বা কে আর জানে?
স্কুল বাঁধের ধারে এলাম। জয়ব্রতদের বাড়িতে গিয়ে হাঁক দিলাম – “জয়ব্রত আছিস? জয়ব্রত আছিস?”
ভিতর থেকে ওর মা বেড়িয়ে এল। এসে বলল, “ও তুমি? এসো। বাবু তো ঘরে শুয়ে আছে।খেলে’ বিশ্রাম নিচ্ছে।”
বাড়িতে ঢুকতেই, জয়ব্রত বেড়িয়ে এল। বলল, “কি রে কি খবর? হঠাৎ, সন্ধ্যার সময়?”
- একটা জ্বরের ট্যাবলেট দে তো।
- কেনো’রে তোর আবার জ্বর হল নাকি?
- না না আমার না।
- তাহলে তুতাই এর ?
- না রে ও বাড়ি চলে গেছে।
- তাহলে?
- একটা দাদুর সঙ্গে আলাপ হল। ওই দাদুর জন্যে।
- কোথায় রে?
- আরে স্কুলের উত্তর দিকে ঘুরতে গিয়েছিলাম তো। আরে, ওই পুরোনো মন্দিরগুলো দেখছিলাম তো, ওখানেই দাদুর সঙ্গে আলাপ। ওই দাদুরই জ্বর।
- ওখানে তো চাষি ছাড়া কেউ যায়না। কে দাদু?
- নাম তো জিঞ্জাসা করিনি... তবে দাদু বলল দাদুর কেউ নেই। সারা গ্রামেই ঘুরে বেড়ায়।
- কেমন দেখতে বলতো ?
- সারা গায়ে সাদা বস্ত্র ,নীচে সাদা ধুতি আর গায়ে সাদা কাপড়ের চাদর জড়িয়ে আছে। বয়স প্রায় ৬৫ বছর, উচ্চতা প্রায় সাড়েপাঁচ ফুট হবে। গায়ের রঙ ধপধপে ফর্সা। গালে উস্কো-খুস্কো দাড়ি।
এই শুনে জয়ব্রত ও কাকিমা দুজনেই চমকে উঠলো। তার পর জয়ব্রত যা বলল তা মনে করলে আমার মন আজও শিউরে ওঠে, গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।
ওর কথা শুনে আমি বাক্রুদ্ধ হয়ে গেলেম। হতভম্ব হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম।
ও বলতে লাগলো, আর আমি শুধু শুনতে লাগলাম।
ও বলল –
সে, প্রায় একাশো বছর আগের কথা – তখন নদীর মানাতে যে মন্দিরগুলো আছে, সেগুলোতে নিত্যপুজা হত।প্রতি সন্ধ্যায় মন্দিরগুলোতে কাঁসর ঘণ্টা বাজতো, সন্ধা-আরতি হত। অনেক মানুষ ওই সব সন্ধ্যায় মন্দিরগুলোতে ভির জমাতো। তবে, প্রতি বছর বান হত, আর সর্বনাশা সেই বান যেমন নদী চরের সব শস্য শেষ করে দিত, তেমনি মন্দিরগুলোর খুব ক্ষতি করত।
তাইতো আগেকার মন্দিরগুলো অনেক উঁচু ভিত তৈরি করে নির্মান করা হত। এখন এ মন্দিরগুলো দেখছিস প্রায় জমির সমান, সেগুলো আগে অনেক উঁচু ছিল। বহুদিন ধরে পলি জমেজমে মন্দিরগুলোর এই অবস্থা।আর, ওই বানের সময়, মন্দিরের পুজারিরা ঠাকুরগুলোকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখতেন। এক বছর – প্রায় ৮০ বছর আগে, হঠাৎ রাত্রে বান এলো – মন্দিরের কোনো পুজারিই সেদিন খবর পাননি। তাই, বান এসে দেবমূর্তি ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। ব্যাস তারপর থেকেই ওই সব মন্দিরগুলিতে পুজা বন্ধ। পুজারিরা কয়েক বছরের মধ্যে মাড়া গেলেন। তারপর একদিন গাঁয়ের এক ব্রাহ্মন – দেবকুমার ঘোষাল–কে ভগবান স্বপ্ন দিলেন, ওই মন্দিরে নুতন দেবমুর্তি প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু, তিনি ওই মুর্তি প্রতিষ্ঠা না করে, লোকের কাছ থেকে মিথ্যা টাকা তুলতে থাকেন।
অবশেষে একদিন রাত্রে, মুর্তি নির্মানের টাকা নিয়ে পালানোর সময় দেবকুমার বাবু পাগল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন, সারা রাত ধরে।
পরদিন সকালে গ্রামবাসীরা তাঁকে উদ্ধার করে।গ্রামের কেউ সেই টাকাতে হাত দিতে সাহস করেনি।অবশেষে, তাঁর ভাই সুদেবকুমার বাবু ওই টাকা নিজের কাছে রাখেন-ঠাকুরের নাম করে।তিনি একদিন স্বপ্নে ঠাকুরকে দেখতে পান।
ঠাকুর তাঁকে বলেন, “তুই আমার যে বৃদ্ধ রূপ দেখলি, এই বৃদ্ধ রূপের একটা মুর্তি বানাবি, ওই মন্দিরের দেওয়ালে। আমার মন্দিরের ভিতরে কোনো মুর্তি রাখতে হবে না। আমার মন্দিরে পুজার কোনো দরকার নেই। আমার যেদিন ইচ্ছে হবে, সেদিন আমি গ্রামের ভক্তের বাড়িতে গিয়ে পুজা নেব। সবাইকে বলবি আমি সবার বাড়িতেই থাকব। যে আমায় ডাকবে আমি তার কাছেই যাব। আমার যাকে ভালো লাগবে তাকে দেখা দেব।আর মুর্তি তৈরি করে, আমার নামে তুলসি দিবি।সেই তুলসি দেবকুমারকে খাওয়াবি। ও ভাল হয়ে যাবে। ও ওর পাপের শাস্তি পেয়েছে। ওকে সৎভাবে বাঁচতে বলবি। গ্রামের সকলকে, সকলকে নিয়ে সৎভাবে বসবাস করতে বলবি।”
এর আগে বাইরের দু- তিন জন ঠাকুরের দেখা পেয়েছেন ওই বৃদ্ধ রূপেই। তারাও এই স্থানে ঘুরতে এসেছিল। কারও বাড়ি যদিও, তোর মত এই গ্রাম বা আশপাশের গ্রামে নয়। সবার বাড়িই বেশ দূরে।
তুই তো বিশাল ভাগ্যবান, তুই যাকে দাদু বলছিস সে দাদু নয়। তিনি পরম আরাধ্য শ্রী শ্রী গোপীনাথ ঠাকুর। চল্, মন্দিরের কাছে। - মন্দিরের দেওয়ালে ওই ঠাকুরের মুর্তি দেখতে পাবি।বন্যাতে, মন্দিরের ক্ষতি হলেও, মন্দিরের গায়ে ওই মুর্তির কোনো ক্ষতি হয়নি। ওই মুর্তি আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়ে গেছে, ভারতীয় ভাস্কর্যের নিদর্শন হিসাবে।
ও তাড়াতাড়ি, একটা আলো নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। অনতিদূরের মন্দিরে কাঁসর-ঘন্টা ঢং ঢং করে বেজে উঠল।
নিজের থেকেই যেন হাতটা কপাল ছুঁইয়ে গেল।
কিছুক্ষনেই ওই ভাঙ্গা পুরানো নদীপারের মন্দিরের কাছে চলে গেলাম। মন্দিরের দেওয়ালে চোখ ফেলতেই -আমি অবাক হয়ে গেলাম। নিজের হাত দিয়েই নিজের চোখ মুছতে লাগলাম।
শরীরের চারপাশে যেন শীতল হাওয়া বয়ে গেল। হঠাৎ যেন, মাথাটা ঘুরে গেল। আমি পাশের জমিতে বসে পরলাম।
মনে মনে বললাম - এটা কি বাস্তবিক!!!! তাহলে কি...