তা হ লে কি... (প্রথম পর্ব) - Sarthak Goswami
তখন সেই পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মনটা ফুরফুরে আনান্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। পাড়ায় খেলা বেশ জমে উঠেছে। যদিও, মানসিক ভাবে আনান্দিত থাকলেও – উরু উরু মন যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল ভ্রমনের আনন্দ। বসন্তের হালকা হাওয়া মনটাকে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল।
সেদিন ওপাড়াতে খেলতে গেছি – বিনা কারনেই একটা ঝগড়া বেঁধে গেল। যদিও কারনটাকে বিনা কারন বলা উচিত নয়। ব্যাপারটা আর কিছুই নয় – শুধু ভুল বঝাবুঝি।
এবার ব্যাপারটা বিস্তারিতই বলা যাক –
সবাই মিলে গোপীনাথ মন্দির-এর পিছনে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। আমি ব্যাট করছিলাম, হরি বল করছিল। উইকেট ছিলনা – ছিলনা বলতে দুটো জুতা রেখে সেদুটিকে উইকেট হিসাবে ধরা হয়েছিল। হরি বল করল, আমি অফ স্টাম্পের বলটা মিস করলাম- একটু ঝুঁকে পরে।
হরি আউট বলে চেঁচিয়ে উঠল। কিন্তু, আমার মনে হল – ওটা আউট থাকেনি।
এই নিয়েই ঝগরা। ব্যাস, খেলা বন্ধ। রেগে বাড়ি চলে এলাম। যদিও, জানিনা এই ঝগরায় আমার দোষ ছিল কিনা।
সন্ধ্যায় বাড়ির দুয়ারে বসে আছি , বিষন্ন মনে। ভাবছি যে, দোষটা আমার ছিলনাতো!
যেহেতু, মনটা ভ্রমনপিপাসু ছিল – তাই ভাবলাম কোথাও বেরিয়ে আসি। হঠাৎ, মনে হল যাই একবার মাসিমনির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।
তুতাই আছে তো, তাই একঘেঁয়ে লাগার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তুতাই, অর্থাৎ অর্ঘ্য গোস্বামী – আমার মায়ের মাসতুতো বোনের ছেলে, মানে আমার মাসতুতো ভাই। আমার থেকে বয়সে ১ বছরের ছোটো।
আমরা ভাই-বোনেরা মাসিরবাড়ি বলতে বুঝি, ওই একমাত্র তুতাইদের বাড়ি।
এক্ষেত্রে একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমার মাসির বাড়ি খুব কাছেই। আমার গ্রাম সোয়ালুক এর পাশেই ভাঙ্গামোড়া গ্রামে। আমার বাড়ি থেকে সাইকেলে খুবজোর ১০ মিনিট লাগে।
আমি যে হাইস্কুলে পড়ি সেটাও ভাঙ্গামোড়াতে। আমার ওই স্কুলের নাম – ভাঙ্গামোড়া নূতনগ্রাম কেদারনাথ চিন্যা মেমোরিয়াল ইন্স্টিটিউশন। মাসিমনির বাড়ি থেকে স্কুল মাত্র ৫ মিনিটের পথ।
স্কুলধারে অনেককিছু দেখার আছে। ভাবলাম এই সুযোগে তাও দেখা হবে।
তখনই মা –এর কাছে গেলাম। গিয়ে , কিছুক্ষন বসে রইলাম। মা বোধহয় কিছু একটা আন্দাজ করেছিল।হঠাৎ মা বলল, “কি রে কি খবর? কিছু ধান্দায় আছিস মনে হচ্ছে। বল কি বলতে চাইছিস?”
- তুতাইদের বাড়ি যাব?
- কবে?
- কালকে।
- কেনো?
- এই একটু ঘুরতে।
- তুতাই এর তো বোধহয় মৌখিক পরীক্ষা বাকি?
- না গো। এই দু দিন হল শেষ হয়েছে। দুজনেই এখন কদিন ছুটিতে। যাই না।।
- কেন পাড়ায় তো ভালোই খেলা শুরু হয়েছে। পাড়াতেই খেল না।
- ধুর্... আজ একটু ঝামেলা হয়েছে। ঝগড়া নয়। তাছাড়া অনেকদিন কোথাও যাইনি তো...
- তোর মাসিমনি জানেনা... তোর মেসোমোশাই থাকবে কি’না – তারপর তোর মাসিমনি বিপদে পড়ুক আর কি?
- না গো আমি জ্বালাবোনা। একটু যাইনা?
- ঠিক আছে। কাল সকালে ৮ তা নাগাদ বেড়িয়ে পড়বি।
- তোর বাপিকে না’হয় আমি বুঝিয়ে বলব।দুষ্টুমি করবিনা’তো?
- না গো। তুমি দেখে নেবে।
মনটা যেন আনন্দে ভরে গেলো। আমি আর তুতাই একসঙ্গে – মানে তো বিশাল মজা হবে...
আনন্দে অপ্রিয় খাবার রুটি, যেন অমৃত মনে হল- সেদিন রাতে।
পরদিন সকাল ৬ টা তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। আর যেন আনন্দ ধরেই রাখতে পারছিলাম না। সকালের খাবার খেয়ে, সকাল ৮ টার মধ্যেই বেড়িয়ে পরলাম সাইকেল এ চেপে। প্রতিদিনের বিরক্তির বাজে রাস্তা, যেন মনে হল স্বপ্নের রাজপথ।তাড়াতাড়ি পৌছে গেলামও।
তুতাই তো দেখে অবাক।বলল, “তুই , না বলেই চলে এলি যে!!”
- কেমন চমকে দিলাম বল।
- চমকানো মানে! তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢোক।
মাসিমনি ও তো দেখে চোমকে উঠলো। বলল, “ কি’রে ঘুরতে? না, তুতাই এর সঙ্গে দরকারে?”
- নাগো ঘুরতেই এলাম।
- কি রে পরীক্ষা কেমন হল?
- ভালোই।
- ফাঁকা ঘরে বসেছিলাম তাই ভাবলাম, এখান থেকেই ঘুরে যাই।
- তা তোর দু’দিদিকেও আনতে পারতিস তো?
- ওরা এলোনা আর কি করব?
তারপর কিছু খেয়ে নিয়েই বেড়িয়ে পরলাম ক্রিকেট খেলতে।
আমাদের খাওয়ার থেকে খেলার ধান্দা সবসময় বেশি ছিল। প্রচুর চোট লাগতো তবু খেলা বন্ধ থাকতো না। খেলা শেষ হলে, ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে দুজনে ভাত খেয়ে নিলাম। তারপর তুতাইকে বললাম, “আজ বিকালে স্কুল ধারে ঘুরতে যাব।”
- বলিস কি’রে খেলা ছেড়ে ঘুরতে? কবে থেকে? পরিবর্তিত হয়ে গেছিস যে।
- না রে খেলা তো সব সময় আছে। চল না একটু আজ ঘুরে আসি।
- গিয়ে কি করবি শুনি। সারাবছর তো স্কুল যাচ্ছিস, তাতেও ঘোরার শখ মিটলনা?
- না রে, আসলে ওই স্কুলের উত্তর দিকের মাঠে যে পুরানো মন্দিরগুলো আছে, ওগুলো দেখার খুব শখ।
- ঠিক আছে যাব না হয়।
দুপুরটাতো গল্প করে কাটিয়ে দিলাম।
বিকাল ৫ টায়, মাসিমনিকে বললাম, “ আমরা দুজনে একটু স্কুলধার থেকে ঘুরে আসছি।”
মাসিমনি বলল, “ সন্ধ্যার আগে ফিরবি কিন্তু।”
একটা কথা বলে রাখি –
আমরা দুজন একই স্কুলে পড়ি। স্কুলের চারধার সবই চেনা।স্কুলের পুর্বপার্শ্ব দিয়ে বয়ে গেছে দামোদর নদ। তাই, নদীতীরের সৌন্দর্য যে বিকেলের সময় দর্শনীয় হবে, তা আর বলতে বাকি রাখে না। তবে কোনোদিনই অনতিদূরের এই সৌন্দর্য দেখবার ভাগ্য আমার হইনি। এতদিনে যেন স্বপ্ন সার্থকের পথে...
দুজনে দুটো সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। ৫ মিনিতেই পৌছে গেলাম স্কুলধারে।
গিয়ে দেখি, স্কুলের মাঠে স্থানীয় দুই দলের মধ্যে ফুটবল খেলা চলছে। দর্শকও ভালই হয়েছে। যদিও খেলাটা ক্রিকেট নয়, তাতে কি, আমরা তো মাঝে মাঝে ফুটবল খেলতাম। আর বাঙালি হিসাবে তো দেখতে ভালো লাগবেই।
তাই দুজনে পরিকল্পনা করলাম যে, যা করার পরে করব, যা দেখার পরে দেখব, এখন খেলাটা দেখা যাক।
টানটান উত্তেজনায় খেলা চলতে লাগল।একপার্শের গোলরক্ষক ছিল, আমার অন্যতম বন্ধু, স্কুলধারেই বাড়ি – জয়ব্রত ঘোষাল। কতকগুলো ভালো বল রক্ষা করে অবশেষে জিতল ঘোষালের দলই। খেলা শেষ হতে হতে অনেক সময় লেগে গেল।
তুতাই বলল, “আজ আর নয়। বাড়ি চল।”
আমি দেখলাম তখন সন্ধ্যা হতে অন্তত প্রায় ৪৫ মিনিট দেরি। আসল উদ্দেশ্য সাধন না করে বাড়ি যাওয়াই বৃথা। তাই আমি বললাম, “বাড়ি ফিরতে তো ৫ মিনিট সময় লাগবে। ঠিক আছে তুই না হয় চলে যা, আমি মন্দিরগুলো একটু দেখে তারপর না হয় যাব। তুই মাসিমনিকে বলবি যে আমি আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরব।”
তুতাই বলল, “আরে ওই মন্দিরগুলোতে তো আর পুজা হয় না, যে এই সময় যাবি, পরে আসব এখন।”
আমি বললাম, “তোর যখন তাড়া আছে তুই বাড়ি যা। আমি আজ দেখেই তবে ফিরব।”
আমার জেদের কাছে ও আর কি বলে, ও বাড়ি চলে গেলো।
আমি স্কুলবাঁধে সাইকেল রেখে মন্দিরগুলির দিকে এগিয়ে চললাম। পরন্ত বিকালে, ডুবন্ত সূর্যের ম্লান আলোকে, সবুজ মাঠের মাঝখানে, নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভগ্নপ্রায় মন্দিরগুলি যেন আমার মনকে স্বপ্নে বিভোর করে রেখেছিল।
জনশূন্য সবুজ মাঠে, পড়ন্ত রোদে আমি যেন তখন আলাদা এক জগৎ -এ এসে পড়েছি। সামনের সুন্দর মন্দিরের গায়ে সুনিপুন টেরাকোটার কাজ থেকে যেন আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। মন্দিরের গায়ে খোদিত আছে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, বিভিন্ন নকশা।
অবাক হয়ে মনে মনে বললাম – আমাদের হুগলি জেলাতেও এ রকম দর্শনীয় স্থান আছে! বোধহয়, এই সব ভাঙ্গা মন্দির আছে বলেই এই স্থানের নাম ভাঙ্গামোড়া,অর্থাৎ - ভাঙ্গা মন্দির দিয়ে এই জায়গা মোড়া।
ভাবলাম, কত লোক বিভিন্ন জায়গায় যায় হাওয়া বদল করতে বা ঘুরতে এখানে আসে না কেন!
এখানে এলে তো, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে পুরানো স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের অগনিত সম্ভার তারা দেখতে পেত।।
অনতিদূরে, অপর একটি মন্দিরের দুয়ারে একটি সাদা কাপড়ের কুণ্ডুলি হঠাৎই আমার দৃষ্টি আকর্ষন করল। কাছে গিয়ে দেখলাম, সেটাকে কাপড়ের কুণ্ডুলি বললে ভুল হয়, তার ভিতরে কিছু আছে।
তার ভিতর থেকে একটা গুঁই গুঁই আওয়াজ বের হচ্ছে। এমত সময় আমি তো রীতিমতো চমকে গিয়েছিলাম।
তারপর মনটাকে শক্ত করলাম। এগিয়ে গিয়ে কাপড়টা তুলে দেখি, এক বৃদ্ধ কুঁকড়ে শুয়ে আছে, আর জল জল বলে গোঁঙাচ্ছে। আমি বুঝলাম- ওনার খুব তেষ্টা পেয়েছে। সামনেই দেখলাম ডিপটিউবওয়েল থেকে জল বের হচ্ছে। হাতে করেই এনে,কিছুটা জল চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলাম। তারপরে আস্তে করে তুলে বসিয়ে, হাতে করে কিছুটা করে জল এনে খওয়াতে লাগলাম। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, “এখন একটু আরাম লাগছে?”
বৃদ্ধ কোনো উত্তর দিলো না। আমি বৃদ্ধকে ভালো করে পর্যবেক্ষন করলাম। দেখলাম – সারা গায়ে সাদা বস্ত্র পরে আছেন। নীচে সাদা ধুতি পড়ে আছেন, আর গায়ে সাদা কাপড়ের চাদর জড়িয়ে আছেন। বয়স প্রায় ৬৫ বছর, উচ্চতা প্রায় সাড়েপাঁচ ফুট। গায়ের রঙ ধপধপে ফর্সা। গালে উস্কো-খুস্কো দাড়ি।
বৃদ্ধটি কোনো কথা বলছে না দেখে , আমি আবার বললাম, “আপনার বাড়ি কোথায়?”
মৃদু কণ্ঠে বৃদ্ধ বলে উঠল, “আমার কোনো নির্দিষ্ট বাড়ি নেই আমি এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াই,এর বাড়িতে একদিন তো ওর বাড়িতে আর এক দিন।”
- সে কি তোমার কেউ নেই?
- না রে ! আমি সেভাবে ভাবিনা। এই গ্রামের সবাই তো আমার লোক। এই যে তুই এসে আমায় জল দিলি, তুই তো আমার কাছের লোক হয়ে গেলি।
- সে না হয় হলাম। কিন্তু তুমি যে এই পড়ে ছিলে , আমি না এলে তোমাকে কে দেখতো?
- বৃদ্ধ মানুষ, কেই-বা দেখবে!! একাই তো পরে থাকি!!
- ইস্ , তোমার কেউ নেই দেখে আমার কি খারাপ লাগছে।
- আমারও তোকে খুব ভালো লাগছে। এখনকার সমাজে এই আমাদের মত লোকেদের জন্য তোদের মতো ছেলেই তো দরকার। যারা, বৃদ্ধদের সাহায্য করবে...বাবা মা’কে দেখবে...
- তুমি তাহলে কি খাও?
- আমি!!(মৃদু হেসে)- কিছুই খাই না। যেদিন কেউ কিছু দেয়, সেদিন কিছু জোটে, নাহলে উপবাস।
- ইস্!! তুমি টিফিনের সময় আমাদের স্কুলের ধারে যাবে – আমরা বন্ধুরা তোমাকে নিজেদের টিফিন থেকে কিছুটা করে দেব।