বিগত দশ বছর ধরে আমরা বিরাজমান। কিছু প্রউক্তুশিল কারণে আমাদের মেইন ওয়েবসাইটটি কিছুদিন বন্ধ ছিল। আমাদের কাজ চলছে, আমরা আবার আসিব ফিরে। কিন্তু ততদিন আমাদের এতদিনের আর্কাইভটা প্রকাশ করা থাকল। অনেক পুরনো জিনিসপত্র পাবেন, যদি কারর কন আপত্তি থাকে আমাদের কে মেইল করে জানাবেন। admin@werbangali.com
আপনি যদি আমাদের e-commerce shop খুজ্জেন তাহলে এই লিঙ্ক এ ভিজিট করুন : shop.werbangali.com

অখণ্ড অবসর - Sourav Mitra

'...এই পান্থশালার আমি এক দীর্ঘকালীন নিবাসী ছিলাম। কালক্রমে এই পান্থশালাই হয়ে উঠল আমার গৃহ। আজ আমি যেন সেই নিজভূমেই পরবাসী হতে চলেছি, চলে ত' যেতেই হবে। তবে আমৃত্যু আমি এই উপাসনালয়ের অক্লান্ত সেবক হয়ে থাকতে চাই।'

নিশ্চয়ই সবাই বেশ হাততালি দেবে, অনেকে বেশ অবাকই হবে একজন শারীরবিদ্যার শিক্ষকের বিদায়ী ভাষণে এরকম সাহিত্যগুণ থাকতে পারে এই ভেবে। চার বারের চেষ্টায় KKT স্যার কোনও কাটাকুটি ছাড়া লেখাটা লিখতে পারলেন। KKT, অর্থাৎ কল্যাণ কুমার ত্রিপাঠি। ক্ষেমাঙ্গ সুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার শিক্ষক, PT স্যার। আজ উনি অবসর গ্রহণ করছেন, কর্মক্ষেত্রে ওনার শেষ দিন নিজের বিদায়ী ভাষণটা তৈরি করলেন। এখনই পড়তে গিয়ে গলা বুজে আসছে, আসল সময়ে না জানি কী হবে, কেঁদে কেটে দিলে...বাচ্চারাও হাসবে হয়ত, বাকীরা পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেবে। হয়ত সবাই মিলে চাঁদা তুলে একটা ঘড়িও দেবে।

ত্রিপাঠিবাবু অকৃতদার মানুষ, বাড়ীতে একটা বিড়াল পোষেন। বাটিতে দুধ রেখে বাড়ির উঠোনের এক কোণে রেখে দিলে বিড়ালটা সেখানে গিয়ে নিঃশব্দে খেয়ে নেয়। রোজের মত আজ বেরোবার আগে বিড়ালকে দুধ দিয়ে বললেন, 'কাল থেকে আমি পেনশনভোগী, বুঝলি? মাছ-টাছ হয়ত অত বেশী দিতে পারবনা তবে এক বাটি দুধ তুই ঠিকই পাবি। আমি বেরোলাম, বাইরে বেরস না, পাড়ার কুকুর গুলো ঘুরঘুর করছে বুঝলি?', বলে ঘরে তালা দিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পড়ে বেরিয়েছেন, একজোড়া নতুন চামড়ার চটি কিনলেও ভালো হত, তাহক, হয়নি যা হয়নি। নির্দায় মানুষের শেষ বয়সে অত শখ থাকা ভালো দেখায় না এই ভাবতে ভাবতে একটা রিক্সায় উঠে বসলেন। পকেট থেকে ভাষণ লেখা চিরকুটটা বের করে বার বার পড়তে লাগলেন, আজ নিশ্চয়ই গিয়ে দেখবেন স্কুলের মাঠের মধ্যে প্যান্ডেল খাটানো, চেয়ার পাতা, হয়ত স্কুল ছুটি দেওয়া হবে তবে সেটা মোটেও ঠিক হবেনা। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে বরং আরও ১ ঘণ্টা বেশী স্কুলে পড়াশোনা চালানো উচিৎ, সেই বাড়তি ঘণ্টায় ছেলেরা পারলে খেলাধুলা করুক। স্বামীজি বলেছেন গীতা নয়, ফুটবল মানুষকে ঈশ্বরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।

স্কুলে গিয়ে দেখলেন মাঠে কোনও মাচা বা প্যান্ডেল কিছুই নেই। হয়ত স্কুলের ভেতরে ছোট করে কিছু করবে, তাই ভালো, তিনি এমন কিছু মহাপুরুষ ত' নন যে...কিন্তু স্কুলের ভেতরেও কিছুই নেই, ক্লাস-টাস সবই চলছে স্বাভাবিক ভাবেই, সেকী, ছেলেগুলোকে লাইনে দাঁড় করিয়ে প্রার্থনা করানো হচ্ছেনা কেন? তিনি দারোয়ানকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে যাবেন সেই সময়েই খেয়াল হল তিনি আজ ১৫ মিনিট লেট, কর্মজীবনে প্রথম বার, ছি ছি, খুবই বাজে ব্যাপার, তাও শেষ দিনে। টিচার্স রুমে গিয়ে দেখলেন প্রায় ফাঁকা, জনা চারেক স্যারেরা বসে আছেন, সবারই কী ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্লাস পড়ল নাকি! ত্রিপাঠিবাবু ঢুকলেন কেউ যেন দেখলেই না, যিনি খেয়াল করলেন তিনি ব্রততীদেবী, ইতিহাসের শিক্ষিকা। পান খেয়ে রক্তের মত লাল মুখটা হাঁ করে বললেন 'ত্রিপাঠিস্যার দেখি আজ একে বারে জামাই সেজে এসেছেন, হি হি হি, কী ব্যাপার?'। কী ব্যাপার! বলে কী? এদের কেউ কী জানেইনা? মনেই নেই? সবার টেবিলের সামনে একটা করে ফাঁকা চায়ের কাপ, যারা আছেন তাঁরাও চুকচুক করে চা খাচ্ছেন। তিনি এলেন দশ মিনিট হল এখনও কেউ জিজ্ঞেসও করলনা চা খাবেন কিনা? শারীরশিক্ষা টা কী কোনও শিক্ষাই নয়? অঙ্ক-বিজ্ঞান-ভূগোল-ইতিহাস এগুলোই শুধু শেখার বিষয়? কত গ্রীক পণ্ডিতেরা জিমনেসিয়ামে মন-মননের চর্চার সাথে শরীরচর্চাও করতেন এরা কী জানেনা? A sound mind in a sound body কথাটা কী ভুল! ত্রিপাঠিবাবুর চোখে সত্যি জল চলে এল, এই বয়সেও তিনি সেই বোকাই রয়ে গেলেন, কত কী ভেবেছিলেন।

আজ ক্লাস সেভেনের P.T -এর পিরিয়ডটা ওনার নেওয়ার কথা, টিফিনের ঠিক আগের পিরিয়ড। আজ উনি সব বাচ্চা গুলোকে মাঠে ফুটবল খেলাতে নিয়ে যাবেন। ক্লাসে গিয়ে দেখলেন ক্লাস পুরো ফাঁকা, সেকী! ছেলেগুলো গেল কই? ক্লাস ফেলে পালালো, কেউ দেখলও না! ছেলেগুলো এত ত্যাঁদড় হয়ছে, আজ ওনার শেষ দিন বলে কী ওরাও ওঁকে মানবেনা! হেড স্যারের ঘরে গিয়ে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করাতে জানলেন রুটিনে সামান্য বদল হয়েছে, আজ উনি বিশ্রাম করুন, ওনার ক্লাসটা ওনার বদলি একটি ছেলে সুরেনকে দেওয়া হয়েছে। যাক হেড স্যারের অন্তত মনে আছে যে আজ দিনটা কি, তবে উনিও 'যান ত্রিপাঠিদা আজ আপনি বিশ্রাম করুন' এটুকু বলেই নিজের কাজে লেগে গেলেন।

টিচার্স রুমে ফিরে ভাবলেন আজ বাড়িই চলে গেলে হয়, কেউ টেরও পাবেনা। পকেটের লেখা কাগজটা দেখে ওনার নিজেরই লজ্জা লাগছে, ইশ্‌। পেছন থেকে কে ডাকল, 'স্যার'। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলেন, রাজু। পুরো নাম রাজকুমার দুবে, ওর দাদু বিহার থেকে কোলকাতায় আসে কাজের জন্য, তারপর থেকে ওরা এখানকারই বাসিন্দা। ও পরিষ্কার বাংলা বলে, এই স্কুলেই পড়াশোনা করেছে। ওর বাবা স্কুলের পেছনে একটা ঘরে থাকত, স্কুলের পাম্প চালানো, উঠোন ঝাড় দেওয়া, ইলেক্ট্রিকের কাজ থাকলে মিস্ত্রি ডাকা সবই ওর বাবা করত, স্কুলের ফান্ড থেকে ওকে মাসোহারা দেওয়া হত, আর স্যারেরা বখসিস দিত, আর এদিক ওদিক কিছু কাজ করে চলত ওদের। রাজুকে কোনও ভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করিয়ে খেলার কোটায় স্কুলের একটা কেরানির পোস্টের চাকরি জুটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছেলেটা ভালো ফুটবল খেলত, ত্রিপাঠিবাবু ওকে কোচিং করিয়ে ছিলেন, ময়দানে কিছু ভালো কোচের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাবেও খেলেছে ছেলেটা, আরও একটু সিরিয়াস হলে বড় ক্লাবেও খেলতে পারত। ত্রিপাঠিবাবু ছেলেটিকে খুবই ভালোবাসেন। রাজু যখন স্কুলে পড়ত তখন ত্রিপাঠিবাবু প্রতি বছর ওর থেকে বুকলিস্ট নিয়ে গিয়ে বই কিনে আনতেন। বললেন 'কীরে ব্যাটা! খেলাটা ছাড়লি, প্র্যাকটিসও হয়ত করিস না, বল কিছু বলবি?'
 
'স্যার, আজ আমার বিয়ে'- বলল রাজু। ত্রিপাঠিবাবু একটু অবাকই হলেন, বললেন, 'সেকি রে ব্যাটা, বলিসনি কেন আগে? কী বুদ্ধি! আমিও এলাম খালি হাতে'।
'না স্যার আর কাউকে বলিনি, আপনাকেই বললাম। বাবা ত' নেই আপনি যাবেন স্যার। আপনার কথা ওকে বলেছি স্যার। আজ সন্ধে ৬ টার সময় মন্দিরে বিয়েটা সেরে ফেলব, এখানে অন্যদের পরে বলব স্যার, এখন না।'

ব্যাটাচ্ছেলে কোনও এক ফ্ল্যাটবাড়িতে জলের কল বসানোর কাজ জুটিয়েছিল, সেখানেরই এক ফ্ল্যাটে মেয়েটি বাচ্চা দেখাশোনার কাজ করত। করিৎকর্মা ছেলে, কাজ করতে গিয়ে নিজের জন্য মেয়েও খুঁজে এনেছে, আবার বছর খানেক লুকিয়ে প্রেমও করেছেন! মেয়েটি ছোটবেলায় বাবাকে হারায়, তাই রাজু চায় উনিই মেয়েটির বাবা হিসেবে ওকে সম্প্রদান করুন। আর রাজুর পক্ষ থেকে ত' উনি যাবেনই।

ত্রিপাঠিবাবু বললেন 'ধুর বলদ, ও হয় নাকি!'
'আমি জানিনা স্যার, আমি ওর মাকেও বলেছি, ওরা খুব খুশি। আপনি না থাকলে ত' আমি ত' কিছুই করতে পারতাম না।'
'নে থাম থাম, হিন্দি সিনেমার ডায়লগ বলতে শিখেছে। আমি নিশ্চয়ই যাব রে', বলতে বলতে ত্রিপাঠিবাবুর চোখ বেঁয়ে জল গড়াতে লাগল। রাজুও কাঁদতে শুরু করেছে। ভরদুপুরে দুটো পুরুষ মানুষ এমনি এমনি কাঁদছে, এ কেমন কথা! ভাগ্যিস কেউ দেখেনি, টিচার্স রুম ফাঁকা।

মন্দিরে গিয়ে দেখলেন রাজুরা ছাড়াও আরও কিছু ছেলে-মেয়ের পরিবার এসেছে, সকলে বিয়ে করতেই এসেছে, হাতে মালা, সিঁদুরের কৌটো, আরও কিছু ডালা, সরঞ্জাম। আজ হয়ত কোনও বিশেষ দিন বা লগ্ন আছে। মেয়েটির বাড়ির লোক এসে ত্রিপাঠিবাবুকে প্রণাম করতে লাগল, মেয়েটির মাও প্রণাম করতে গিয়েছিলেন, কী বিপদ! হয়ত তিনি শিক্ষক মানুষ বলে তাঁকে সম্মান জানাতে চাইছেন তাঁরা, সরল মানুষ ত', হয়ত ভাবছেন যে প্রণাম করাটাই সম্মান জানানোর সঠিক ও একমাত্র উপায়। মেয়েটিকেও দেখা গেল, শ্যামলা গায়ের রঙ, মুখখানা ঢলঢলে, উনিশের বেশী বয়স হবেনা। ইশ্‌ মেয়েটার নামই জানা হয়নি। 'তোমার নাম কী মা?' বললেন ত্রিপাঠি স্যার। মেয়েটা চোখ নামিয়ে বলল, 'আশালতা।'

প্রায় ত্রিশ বছর পর ত্রিপাঠিবাবুর বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। কী সুন্দর আর সরল একটা নাম, কিন্তু এতগুলো বছর মাঝখানে পেরিয়ে গেলো এই নামটা কেন একবারও শুনলেন না তিনি। সেই কলেজে পড়ার সময় এই নামের একটি মেয়েকে তিনি জানতেন। ত্রিপাঠি স্যার তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে, বেপাড়ার এক ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে সেখানে মেয়েটিকে দেখেন। উনি মেয়েটির দারুণ প্রেমে পড়েছিলেন। কায়দা করে মেয়েটির নাম ও বাড়িটাও জেনে নিয়েছিলেন। বেপাড়ার একটি ছেলেকে একটা বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করতে দেখে ওই পাড়ার ছেলেগুলোও ওনাকে ধমক ধামক দিয়েছিল, তারপর মারামারি সে এক ব্যাপার, উনিও শেষ অবধি যুঝে গেছিলেন। তবে মেয়েটি তাঁকে মোটেও পাত্তা দেয়নি। ছ' মাসের মাথায় মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। সেই ব্যর্থ প্রেমের এমনই অভিঘাত যে তিনি বাকী জীবন আর বিয়েই করলেন না।

ত্রিপাঠিবাবুর চোখ অনর্গল জলে ছেয়ে যাচ্ছে, দৃষ্টি ঝাপসা, তিনি আজকের মেয়েটির মুখের জায়গায় যেন তাঁর সেই হারিয়ে যাওয়া ত্রিশ বছর আগের মুখটি ভেসে উঠতে দেখছেন। চোখ টিপে একটু জল বের করে দিলে দৃষ্টি পরিষ্কার হচ্ছে বটে তবে পরের মুহূর্তেই আবার যেই কে সেই। কী বিড়ম্বনা, আশেপাশের লোকগুলো কী যে ভাবছে। এই হয়ত বয়সের ধর্ম, কারণে-অকারণে চোখে জল চলে আসে, কিছু একটা করতে হবে, লজ্জার ব্যাপার, ভাবতে লাগলেন ত্রিপাঠিবাবু। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, 'শোন মা, এই বাঁদর যদি তোকে কখনো কষ্ট দেয় আমাকে বলিস, ওকে ডুগডুগি বাজিয়ে নাচাবো।' সবাই বেশ মজা পেল, মেয়েটিও প্রথমবার ওনার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে হাসল।

বাড়ি ফিরে ত্রিপাঠিবাবুর খুবই লজ্জা করতে লাগল, তবে এখন সম্পূর্ণ অন্য কারণে। মেয়েটির বাবা হিসেবে তিনি গেলেন অথচ কিছুই নিয়ে গেলেন না। কাজটা মোটেও বুদ্ধিমানের মত হয়নি, অবশ্য এসব বুদ্ধি মেয়েদের মাথা থেকেই বের হয় ভালো, তাঁকে ত' বুদ্ধি জোগানোর কেউ নেই। যাই হোক, ব্যবস্থা তিনি মনে মনেই করে ফেলেছেন। তাঁর ঠাকুমা তাঁকে একটি সোনার হার দিয়ে গিয়েছিলেন। উনি বানিয়েছিলেন ওনার ভাবী নাত-বৌ এর জন্য। যাক সেটা কাজে লাগবে এবার।

চেয়ারের উপর থম মেরে বসে আছেন তিনি, এভাবেই থাকবেন যতক্ষণ ইচ্ছা, এখন ত' ওনার অখণ্ড অবসর। ওনার বিড়ালটা দুধ খাওয়া ছেড়ে হাঁ করে ওনার দিকে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত ও বুঝতে পেরেছে আজকের দিনটা অন্যান্য দিনের মত নয়। মনুষ্যেতর পশুদের এসব বোধ খুব প্রখর।