অনন্যদিন - Sourav Mitra
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় "মহাসিন্ধুর ওপার থেকে" গানটা শুনেছিলাম, বাজছিল কোথাও। বাবার খুবই প্রিয় গান, বাবার কথাও মনে পড়ছিল তাই সকাল থেকে। বিকেলের দিকে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল, স্বপ্নে দেখি বাবা সমুদ্রের ধারে একটা চেয়ারে বসে আছে, হাতে একটা আতা নিয়ে (ইশ্! কতদিন পরে বাবাকে দেখলাম, আর বাবার হাতে আতা কেন দেখলাম তাও বুঝলাম না, এই সম্পর্কে ফ্রয়েড, বা ইয়ুং সাহেব কিছু বলেছেন কিনা দেখতে হবে)।
আমাকে বলল বাবা, "তোকে একদম আমার বাবার মত দেখতে হয়েছে (আমার ১২ বছর বয়স থেকে বাবা এটা আমাকে বলত), কেমন আছিস রে পিকু?", আমি বললাম, "ভালো আছি, তুমি খোলা জায়গায় এভাবে ফল খেয়োনা বাবা, গাড়িতে উঠে এস"। বাবা চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার মাথায় ফুঁ করতে লাগল, আমি বললাম, "কী করছ বাবা?" বলা মাত্রই ঘুমটা ভেঙে গেল, দেখি ড্রাইভার দাদা গাড়ির ভেতরে তার মাথার ওপরের পাখাটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন, পেছনের সীটে আমি জেগে গেছি দেখে বললেন, "দাদাভাই খুব গরম না? জামাটা আলগা করে দেন, ব্যাটাছেলে মানুষ ত", কেউ কিছু ভাববে না।" ওনার উপরে আমি খুবই বিরক্ত, শেষ দুই ঘণ্টা ধরে খুবই আত্মবিশ্বাসের সাথে এক একটি রাস্তা ধরছেন আর ১৫-২০ কিমি যাবার পরে জানা যাচ্ছে সেটা ভুল রাস্তা। তবে তাতে উনি একটুও বিব্রত বোধ করছেন না, অম্লান, অমলিন হাসি মুখে লেগে রয়েছে সারাক্ষণ। কিন্তু এক অচেনা মানুষ যার সাথে আজকের পর আমার হয়ত আর দেখাও হবেনা, এমন একজন আমার প্রতি এই মুহূর্তে যে মমতা দেখালেন তাতে আমার বিরক্তি ভাব পুরোই কেটে গেল।
আজ আমার এক দিদির বিয়ে, দিদি বলতে আমার প্রয়াত বাবার জেঠতুতো দাদার মেয়ে, তার বিয়ে, খুব বেশী দূরের সম্পর্ক নয় যদিও। তাদের বাড়ি কল্যাণী, ঘুরতে ঘুরতে আমরা নদীয়া জেলারই কোনও এক জায়গায় এসে পড়েছি, তবে গন্তব্যের সম্পূর্ণ উলটো দিকে। আর যাওয়া হবে না, আমি এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিলাম এদিক ওদিক ঘুরে কলকাতাতেই ফিরে যাবো, এমনিতেই বলেছিলাম আমার কাজ-টাজ আছে, তাই কেউ আশাও করছে না যে আমি যাবো, কাজেই, থাক। কলকাতা পেরোনোর পর থেকে ঘুরেই চলেছি, তাই চালক ভদ্রলোককে বললাম এখন একটু জিরিয়ে নিই, আপনিও বিশ্রাম করুন, একটু পরে না হয় ভাবা যাবে। গাড়ি অবশ্য আমার নয়, কেনার ক্ষমতাও কোনওদিন হবেনা, আমার খুব কাছের এক বন্ধু ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
আমি লেখালিখি করে একটু নাম-টাম করেছি, ভালো টাকা পাওয়া যায় বলে কিছু টিভি সিরিয়ালের স্ক্রিপ্টও লিখি এই যা। আমার বন্ধুটি একজন বড় সরকারি অফিসার, তাকে একটা নন-এসি গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলাতে এই গাড়িটা পেলাম এবং তাও নিখরচায় (দ্বিতীয়টি তে আমার চরম আপত্তি সত্ত্বেও)। এটা একটা পুরনো এম্বাসেডার, সীটে নড়লে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হয়। থেকে থেকে কোথায় যেন ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে। কিন্তু চলছে, আর ভালোই চলছে। গাড়ির তেলের খরচ কোত্থেকে যাচ্ছে সে নিয়ে আমার কোনও ধারণাই নেই, আশা করি ও কোনও সরকারি গাড়ি আমার জন্য পাঠায়নি, তা করে থাকলে খুবই অন্যায় করেছে, যদিও সরকারি কোনও স্টিকার দেখা যাচ্ছে না। তবে আমি গাড়িটা না নিলে এবং টাকার কথা জিজ্ঞেস করলে আমার বন্ধুটি হুলস্থূল ব্যাপার করবে, তাই বলা ভালো আমি এক প্রকার বাধ্য হয়েছি। তবে এও ঠিক, আমি জানি যে ও অনৈতিক কিছু করবেনা।
গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার ভদ্রলোক খাচ্ছিলেন, বললেন ওনার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, তাই বেশিক্ষণ খালি পেটে থাকা তার শরীরের পক্ষে ভালো নয়। খেতে খেতেই "দাদার বাড়িতে ক"জন?", "সংসার টংসার করা হয় নি?", "সেকি? এই ত" সময়...", "দাদার নিশ্চয়ই কারও সাথে ভাব-টাব আছে" এই গোছের প্রশ্ন করে চললেন, আমি আবার বিরক্ত বোধ করতে লাগলাম। লোকটি ভালো স্বভাবের, ভালো স্বভাবের মানুষের বিচার-বুদ্ধি থাকে কম, লোকে কিসে বিরক্ত হচ্ছে না হচ্ছে সে বোধ থাকেনা। শহুরে সভ্য বিচক্ষণ মানুষের পরের ব্যাপারে এত আগ্রহ থাকেনা, লোকের ভালো-মন্দ, দুঃখ-সুখে কিছুই আসে যায় না, নিজেদের নিয়েই আছে। আমরা এতেই অভ্যস্ত, আর এইসব লোকেদের গায়ে পড়া মনে হয়।
"দাদা, আপনিও খান একটু, কিছুই ত" খান নাই। কচুর শাকটা একটু খেয়ে দেখেন, আমার মায়ের হাতে বানানো।" বললেন উনি।
"না দাদা, পরে সিগারেটের দোকান দেখে একটু দাঁড়াবেন পারলে। এখানে ভালো দেখার মত জায়গা কোথাও আছে, জানেন? হলে সেখানে ঘণ্টা খানেক থেকে কলকাতায় রওনা দেবো।" বেকার সময় নষ্ট, এর চেয়ে বাড়িতে বরং গল্পটা নিয়ে লেগে থাকলে কাজে দিত। পরশুর মধ্যে প্রকাশককে পাকাপাকি কিছু একটা শোনাতেই হবে, অগ্রিম নিয়ে বসে আছি। লজ্জার ব্যাপার।
"স্যার", ভদ্রলোক ডাকলেন। শুরুতে স্যার ডাকছিলেন, আমি না বলাতে বন্ধ করেছিলেন, তারপর থেকে মাঝে মাঝে "স্যার", কখনও দাদা ডাকছেন।
"বলছি কী, যখন যাবেনই না, চলেন না আমার বাড়ি। এখান থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে।"
"না, দাদা, অনেক কাজ ফেলে এসেছি, সময়টা যখন বেঁচেই গেল..."
"বেশীক্ষণ লাগবে না দাদা, এই ঘণ্টা খানেকের ভিতরেই আপনাকে আপনার বাড়ি পৌঁছে দেব, চলেন না"-
বোঝ! বাড়িই হল গিয়ে ৫০ কিলোমিটার দূর। যেতেই লাগবে কতক্ষণ তার নেই ঠিক আর উনি হিসেব করে বলে দিলেন আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ওনার বাড়ি গিয়ে, একটু বসে আবার বাড়ি ফিরে যেতে পারব। ইনি সেই ধরণের লোক যাদের কোনও জায়গা কোথায় জিজ্ঞেস করলে বলবেন "এই ত" আর ৫ মিনিট", আসলে সেটা হয়ত আরও ২০ কিমি। ইনি কাউকে যদি বলেন আর ২ মিনিটে আসছি তাহলে ২০ মিনিট পরে এসে পৌঁছবেন। এদের কথার কোনও দাম নেই, আর এদের কাছে সময়েরও কোনও দাম নেই।
উনি বলে চললেন- "দাদা, বলছিলাম কী, আজ আসলে আমার ছেলের জন্মদিন। পাঁচ বছরে পড়ল। আপনি গেলে ওকে একটু দেখবেন আর ওর একটা নামও দিয়ে আসেন। আমি আপনার কথা শুনেছি স্যার, আপনি গুণী মানুষ, আপনাদের মত লোকেদের সামনা সামনি আমরা ত" বেশি আসতে পারিনা। ছেলেটাকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করব, আমার দেওয়া নামটা আমারই পছন্দ নয়, অশিক্ষিতের দেওয়া নাম বুঝতেই পারছেন স্যার, হে হে। একেই বাবা ড্রাইভার, উপর থেকে আমার দেওয়া নামটা নিয়ে যদি স্কুলে হাসাহাসি হয় আমাকে হয়ত সারাজীবন ঘেন্নাই করে চলবে, পরিচয় দিতে না জানি কতই লজ্জা পাবে।"
আমি আর ওর দেওয়া নামটা জানতে চাইলাম না। তার চেয়ে যাওয়াই যাক ওনার বাড়ি। তাছাড়া ওনার বলার মধ্যে একটা স্বাভাবিকতা আছে, মানুষ কাউকে তার বাড়িতে ডাকলে অনেক নাটকীয়তা করতে ভালোবাসে। অন্য কেউ হলে হয়ত বলত, "সাহেব আমার বাড়ির সামনে একটা ৫০০০ বছর পুরনো বটগাছ আছে, তাতে একটা ভুত আছে সে রোজ গাঁয়ের মুরুব্বিদের সাথে দাবা খেলে, নেমন্তন্ন বাড়িতে পাত পেড়ে খায়", আবার শহুরে ভদ্রলোক হলে বলে "কিচেনটা দারুণ সাজিয়েছি, বসার ঘরে বিদেশী মার্বেল লাগিয়েছি, একদিন এসে দেখে যেও", আবার আমার পিসির মতন কেউ হলে বলতেন,"পিকু আয়, বাবানের রেজাল্টটা দেখে যাস"। বাবান আমার পিসতুতো ভাই, প্রতিবার ফার্স্ট হয় আর প্রতি বছর ওই একটি দিনেই আমি পিসির বাড়ি যাওয়ার নেমন্তন্ন পাই। ইনি স্বাভাবিক ভাবেই বললেন, আন্তরিক মনে হল। "আমি বললাম চলুন তাহলে, তবে হয়ত বেশীক্ষণ বসতে পারব না দাদা, কিছু মনে করবেন না প্লিজ।"
গাড়ি চলছে। সামনের সীটে আরাম পাচ্ছি বেশী, হাওয়াও বেশী লাগছে। ড্রাইভার সাহেবকেও বেশ খুশি লাগছে। "বুঝলেন ভাই", বললেন উনি, (এই প্রথম ভাই বললেন, আগে হয় দাদা নয়ত ত" স্যার বলছিলেন, আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠেছেন, ভালো ব্যাপার) "বছর সাতেক আগের একটা সন্ধ্যে, আমি ওইটা কোনওদিনই ভুলতে পারব না, আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর সব চাইতে সুন্দর সন্ধ্যা", উনি একটা গল্প শুরু করবেন মনে হচ্ছে, গ্রাম বাংলার মানুষের গল্পের প্রিয় বিষয় ভূত, সেটা হলে আমি ওনাকে মাঝখানেই থামাবো, নয়ত, ধৈর্য ধরে শুনব।
"আমি তখন আপনাদের কলকাতায় ট্যাক্সি চালাই, শিয়ালদা ষ্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে প্যাসেঞ্জার তোলার জন্য অপেক্ষা করছি, একসময়ে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর একটা বাচ্চা মেয়ে, ১৯-২০ বছর বয়স হবে ভাই, ষ্টেশন চত্বরে অল্প আলোয় আমি মুখটা ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু বড় রাস্তায় আসতেই ভালো দেখতে পেলাম। এমন সুন্দর মুখ, ভগবানের দিব্যি ভাই, আমি আজও দেখিনি। ভগবান ওর মুখে যেন পৃথিবীর সব লাবণ্য ঢেলে দিয়েছে। বলতে লজ্জা নেই ভাই আমার গাড়ি চালানো তখন মাথায় উঠছে, আমি আয়নায় ওই মেয়েটারই মুখ দেখতে লাগলাম, আমার পাকা হাত ত" অসুবিধা হয় নাই। মেয়েটা সাথের লোকটাকে মামা বলে ডাকছিল"।
ড্রাইভার মশাই প্রেমিক মানুষ মনে হচ্ছে, কবির মত একটা মেয়ের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিলেন। চলন্ত গাড়িতে গল্প শুনতে খারাপ লাগছে না।