চিঠিটা আজও পোস্ট করা হয়নি (২) - দেবমানী সাহা
সকাল থেকে হাজার বার বই নিয়ে বসেও ঠিক পড়া হলনা। কেন জানিনা। মন টা কেমন করছে। খারাপ না ভালো সে বিষয়ে নিজের ই সন্দেহ,দুঃখ না কষ্ট সে বুঝতেও দোনোমনা চলছে বেশ খানিক টা। ছুটির দিনের মেজাজ কোথায় ফুরফুরে থাকবে তা না,বেজায় গণ্ডগোল মনের দেশে।
কি করা যায় ভেবে যখন মাথায় পেন খাতার কথা এলো তখন তীরে এসে তরীটি বেশ সাফল্যের সাথে ডুবে কুপোকাত টি হলেন।খবরের কাগজ ছাড়া,ধারে কাছে সাদা পাতার লেশ মাত্র নেই।মনে মনে ভাবলাম,"স্টুডেন্ট" ছাপটি আদব কায়দায় ধরে রাখতে পারলেও সামগ্রিকভাবে যথার্থতা প্রমাণে আমি অক্ষম।অগত্যা আলমারির ঝুল ধরা উপরের কাগজের সারিতে হাত দিতে হল।কিছুক্ষণের প্রচেষ্টাতেই হলদে হয়ে আসা (খানিক মরচে ধরা লোহার মতই আর কি) এক দিস্তা জরা জীর্ণ কাগজ হাতে এলো।অতি রুগ্ন কাগজ গুলি ততক্ষণে অবশ্য আমার মনকে এক পলকে বেশ প্রাণবন্ত করে তুলেছে তা বলাই বাহুল্য।
প্রিয়
...............,
যখনই মন খারাপ করে তোকে খুব লিখতে ইচ্ছে করে...চিঠি... ধুর আমাকে খুব সেকেলে ভাবছিস বল? ফেসবুকে পিং না করে আমি নাকি কাগজ নিয়ে বসলাম। কি করি বল তো? নাক উঁচু মানুষ টাকে তো এখন তুই ই নাম দিয়ে ছিস "নাক-ভোতা"।এই জানিস,তুই নাক ভোতা বলার পর থেকে চল্লিশ বার বোধ হয় আয়নায় নিজের মুখ দেখেছি,কই একটুও তো ভোতা হয়নি...
সেদিন একটা গল্পের বই পড়ছিলাম।না,তোর অতি প্রিয় নীললোহিতের মৃত্যুর আগের শেষ উপন্যাসটি একেবারেই নয়।তবে বেশ সুন্দর,চেনা চরিত্রগুলোকে বেশ অচেনা ভঙ্গিতে লেখা।আবার একটা পর্যায়ে ফিরে আসার হাতছানিও আছে গল্পে।
কেন এটা থাকে বলতো?আমার মনটা উথাল পাথাল হয় এসব পড়ে।মনে হয় পুড়িয়ে ফেলি বইটাকে তখনি,কিন্তু সেই আগুনের তাপ হয়তো আমার একান্ত আড়াল করে রাখা মুহূর্তগুলোকে পুড়িয়ে দেবে।সেই ভয়েই পোড়াতে পারিনি।
সময় ঘুরে চলেছে খুব দ্রুত।কিছুদিন আগে ঘুরে আসা পুরীর সমুদ্রসৈকত যেন আর টানছে না আমায় আবার ফিরে যাওয়ার জন্য।ভ্রমণপিপাসু বাঙালির নাম কলঙ্কিত হলেও আমি আজ উদাসীন।পরিযায়ী পাখি হয়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে বহু দূরে,সম্পর্ক ভালোবাসা বন্ধন- সব বাধা কাটিয়ে।নিঃসঙ্কোচে আজ বলছি তোকে - যাকে ভালবেসেছি,সে সম্মান দেয়নি।যাকে আদরের টানে বেঁধেছি,সে আমার ভুলের মাশুল গুনছে বাঁধন খুলে দূরে চলে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে।আর যাকে কাছে আসার সুযোগ দিয়েছি বিশ্বাস করে,মনের অস্থিরতা মাঝে মাঝে সেই বিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে।আমি আজ বিশৃঙ্খল,আমি আজ অরাজকতার সীমানার বাঁধ ভাঙা ঢেউ,সেই ঢেউ যা শুধু আছড়ে পড়তে চায় শান্তির পারে,যেখানে কলরব তোলার স্পৃহা নেই,যেখানে ঘোলা জলে নুড়ি কুড়োবে না কেউ,জনমানব শূন্য প্রান্তর।
কঠিন ভাষা গুলোর চাপে সহজ কথা গুলো তো জানানো হলই না।বাড়িতে সব্বাই ভালো আছে।আমি কেমন আছি সে তো শুরুতে আমার মত করে জানিয়ে ই দিয়েছি।তোর ও নিশ্চয়ই খুব ভালো দিন কাটছে?উত্তর দিবি নাকি কাগজে কলমে??
নাকি দু শব্দের মোবাইল মেসেজ এই উত্তরপত্র সেরে দিবি?কোনটা?
ইতি,
তোর চৈতি
নাহঃ!!!!
ঝড়ের রেশ নেই যা উড়িয়ে নিয়ে যাবে তোর কাছে আমার এই চিঠি,আগের বারের মত আরও কিছু শব্দ কাগজে দাগ কাটতে পারলেও তোর কাছে তারা কখনই পৌঁছবে না।কখনও তারা তোর ঠিকানা খুঁজে পাবেনা।
কলিং বেলটা বাজতেই চমকে উঠে দরজা খুলতে গেলাম।বাবা ঢুকলেন।মুহূর্তে ভয়ের শিহরণ গা বেয়ে গেল আমার।দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে খাটে বিছানো কাগজ গুলো কোনোমতে গুটিয়ে জানলা দিয়ে ক্ষণিকের জন্য দম বন্ধ করে ছুঁড়ে দিলাম।গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়াল মনে হল।চিঠিটা আজও পোস্ট করা হলনা।