খেলার মাঠ - দেবাশিস বিশ্বাস
ধরো, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলে সকালে উঠে জগিং করা প্রৌঢ়ের দল বাড়িতে বসে ঝিমোচ্ছে? ফুটবল নিয়ে আর কাড়াকাড়ি করছে না ক্লাবের ছেলেরা? হোমওয়ার্ক না করে খেলতে যাওয়ার জন্য আর বকা খাচ্ছে না পাশের বাড়ির সুদিপ্ত? মাঠের ভিতর দিয়ে আর শর্টকাট নিচ্ছেন না ব্যাঙ্কের কেরানী বিকাশবাবু? বিকেল হলেই আর ফুচকা খেতে জাচ্ছে না ও পাড়ার কিশোর শ্যামল দের নতুন বউদি? খেলার মাঠের পাশের নারকেল গাছটার মাথায় আর কানাকুয়ো টা ডাকছে না দুপুর বেলায়? ধরো, দেখলে খেলার মাঠটাই নেই আর?
আমরা যারা এখন কৈশোর পেরিয়ে একটু একটু করে জীবনের দিকে পা বাড়াচ্ছি, তাদের কাছে এক সময় খেলার মাঠটা ছিল রোজকার স্কুল বা টিউশনের মতই অতীব প্রয়োজনীয়।সারাদিনের জমে থাকা সমস্ত অপেক্ষা যেন বিকেল চারটেয় গিয়ে শেষ হত সেই মাঠে। বর্ষায় কাদা মাখামাখি করে যখন একটা ফুটবল নিয়ে যখন কাড়াকাড়ি করত ক্লাস ইলেভেনের বাবাই আর সেকেন্ড ইয়ারের পলাশ, তখন সিনিয়রিটি পড়ে থাকত মাঠের পাশে রাখা হাওয়াই চপ্পলের সাথে। শর্টপিচ থেকে লংপিচ, ইষ্টবেঙ্গল থেকে মোহনবাগান, রাজনৈতিক সমাবেশ থেকে পাড়ার ফাংশন সব কিছুতেই পাড়ার খেলার মাঠগুলো এক অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। শীত আর গরমের ছুটিতে মায় বন্ধের দিনগুলোতেও নিয়ম করে চলত খেলাধুলা। নয় ওভারের ম্যাচ যেমন চলত এদিকের বল ওদিকের গোলে ঢুকিয়ে দেওয়াও চলত দেদার। নিয়ম করে পুরো ছোটবেলাটা জলকাদা মাখিয়ে হাত ধরে মাটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এই খেলার মাঠ গুলো।
কিন্তু শুধু কি ‘খেলার’ মাঠ?
টিউশন পড়ে ফেরার পথে খেলার মাঠে থাকা কৃশানুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কতবার মুচকি হেসেছে ক্লাস টুয়েলভের বুলটি সেটা কি কেউ গুনে রেখেছে? কৃশানুও যে শুধু সোম-বুধ-শুক্রবার করেই সন্ধ্যে ছটায় পাড়ার মাঠে আসত সেটাই বা কে জানত? শেষমেশ কোন এক শুক্রবার হাতে হাত ঠেকল, আদান প্রদান হল মনের কথা, আর দুজনের প্রেমের সাক্ষী হয়ে রইল রাস্তার দিকের গোলপোস্ট টা।
“বছর দশেক আগে বাংলা ক্যালেন্ডারের শেষ দুটো দিন চড়কের মেলা বসত ওই মাঠে। পাড়ার সব ছেলেরা একসাথে যেত হল্লা করতে করতে, তারপর জিলিপি, জিবেগজা আর বাদামভাজায় মজে যেত নিজেদের মত করে, ছোট বাচ্চাগুলো হা-করে চড়ক ঘোরা দেখত। একটু সন্ধ্যের পর কাজ সেরে আসতাম আমরা বাড়ির মা বৌঠানরা, মায় কাজের মেয়েটা অবধি। এ বাড়ি ও বাড়ি মিলিয়ে সমস্ত পাড়ার মহিলারা চলে আসত মেলা দেখতে, তারপর রাত করে সবাই একসাথে ফিরে আসতাম মেলা দেখে”।- হাসতে হাসতেও নস্ট্যালজিক হয়ে পড়লেন রানাঘাটের পালচৌধুরী বাড়ির ঠাকুমা। দুর্গাপুজো কালিপুজো গুলোয় সব আনন্দ সব আলো তখন এই খেলার মাঠ জুড়ে। বিসর্জনের পরে অবশ্য আবার স্বরূপ ধারন করতে দেরি করত না।
কিন্তু এখন সেসব কই? শহর জুড়ে প্রোমোটারদের উৎপাতে খেলার মাঠ এখন বাতিলের খাতায়। বড় বড় হাউসিং সোসাইটি, নইলে শপিং মল গুলো খেলার মাঠগুলো কে উচ্ছেদ করে নিজেদের ভিত গাঁড়তে ব্যস্ত। আর গ্রামে গঞ্জে এখনও কষ্টেসৃষ্টে যা দুএকটা মাঠ পড়ে আছে,তাতেই বা সময় কাটানোর মত সময় কার আছে? ছোট বাচ্চাগুলোর শরীর তো এখন শুধুই কোচিং ক্লাস, গ্রুপ স্টাডির ঘরে আবদ্ধ, আর মন কম্পিউটারে। খেলার মাঠের সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে গোল্লাছুট, কানামাছি, কুমিরডাঙ্গার মত খেলারাও। তাই পাড়া, গলি, মাঠ, ঘাট ছেড়ে আমাদের দুনিয়াটা আমাদের ঘরেই, দু একটা টেবিলের চারপাশেই ঘোরাফেরা করছে। সেই সাথে অবলুপ্তির পথে বাঙালীর আরও একটা ঐতিহ্য, হারাচ্ছে আরও একটা সেন্টিমেন্ট। তাহলে কি সত্যিই ধুলোমাখা দিনগুলোর স্মৃতি ধুলোতেই মিশিয়ে যাবে? বাংলার মানচিত্র থেকে একসময় উধাও হয়ে যাবে খেলার মাঠ নামক চিত্রটা? আর আমার ছোটকাকুর মেয়ে সুরভির বাচ্চারা যখন ক্লাস ফাইভে উঠবে, তখন হিস্ট্রি, বা জিওগ্রাফী, বা মাঝামাঝির কোনও একটা সাব্জেক্টের থার্ড চ্যাপ্টারের একটা ভীষণ ‘ফানি’ নাম পড়ে খিলখিলিয়ে উঠবে, “খেলার মাঠ”।