সুখে থেকো - Kamal Kumar Biswas
সুখে থেকো
রোজ সকালে; পূবের আকাশ তখনও লাল হয়নি, দরজায় শব্দ । বুছতে পারি পেপার বয় কাগজ ছুড়ল। ভোরে উঠলে মাঝে মাঝে ওর সাথে দেখা হয়। কথা হয়না। মলিন হাসি , দ্রুত সাইকেল চালিয়ে অন্য দরজায় চলে যায়। বয়স ১৪-১৫ হবে , নাম...। এদের অনেকের মত একটা আছে। তবে দরকার না পরলে মনে রাখিনা আমরা । কেন জানিনা ! একদিন আমার বউকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি ওর নাম সোনাই । আদর করে বাড়িতে সোনা বলে ডাকে । পাশের কোন বস্তিতে থাকে । মাসের শেষে কাগজের টাকা নিতে আসে । ব্যাস , আমার বউ এর বেশি জানতে চায় না । কোন কারণে কাগজ না এলে বা হিসেবে ভুল , আমার বউ এর বেশি জানতে চায় না । কোন কারণে কাগজ না এলে বা হিসেবে ভুল হলে যাতে - “সোনাই...।” বলে হাঁক পেরে দুটো কথা শোনাতে পারে।
হঠাৎ আমার ভীমরতি হোল কিনা জানি না , সোনাই এর সাথে কথা বলার ইচ্ছা হল । এরকম আমার মাঝে মাঝে হয় । বোকা বোকা ইচ্ছা । শুনলে কেউ ভাববে – কেন বাবা নাটক করছ? দেখাতে চাও তুমি ওদের জন্য খুব আন্তরিক ? সোনাই এর সাথে কথা বলে কি বোঝাতে চাও ? না না সত্যি বলছি আমি কিছু বোঝাতে চাই না । আমরা সবাই জানি ও দরজায় দরজায় কাগজ বিলি করে । এটাই ওর কাজ । একটু বড় হতেই আমরা ওকে এই কাজ দিয়েছি। লেখা পড়া ? হিসেব করতে জানে । একদিন সামনের বাড়ির ভদ্রমহিলা একটু গলা উঁচিয়ে – “ বাঃ বাঃ, তুই দেখছি ভাল হিসেব জানিস ! ১৫০ টাকা দিয়েছি আর ২ টাকা দিতে হবে, তাইতো? ”
“হ্যাঁ কাকিমা । নাহলে মালিক আমার থেকে ২ টাকা কেটে নেবে। কত আর পাই বলুন।”
ও হিসেব ঠিক বলায় ভদ্রমহিলা যেন একটু বিরক্ত হলেন। গড় গড় করে ভিতর থেকে একটা ২ টাকার কয়েন এনে—“ এই নে, হিসেবটা ঠিকমত করবি ” ভাবটা এমন যেন দয়া করে ২ টাকা দিল। আবার সেই একচিলতে মলিন হাসি—“ঠিক আছে কাকিমা”।
রোজই ভাবি সামনের রবিবার সোনাইকে ডেকে বসিয়ে কথা বলব। কিন্তু রবিবার ঘুম থেকে উঠতে বড্ড দেরি হয়। ততক্ষণে কাগজ দিয়ে ও চলে যায় । না এভাবে হবেনা । সোনাইকে ধরতে হলে ভোরবেলা উঠতে হবে । একদিন দেখা হোল—“সোনাই তোমার সঙ্গে কথা আছে । আসবে একবার । ”
সাইকেলটা ঘুরিয়ে গেটের কাছে এসে—‘বলুন ’
“ না না একটু সময় চাই । বিকেলে আসতে পারবে ?”
“ ঠিক আছে । মায়ের শরীরটা আবার ভাল যাচ্ছে না । চেষ্টা করব আসতে ।” সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে দ্রুত চলে যায় । আমার ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিছু জানার প্রবল বাসনা । কোন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার কিংবা বাহবা পাবার মত কিছু নয় । মূল্যহীন জীবনের একটুকরো গল্প ।
সেদিন বিকেলে আসেনি ও । তারপর আমিও ব্যস্ত হয়ে পরি । সময় এগিয়ে চলে ।
একদিন বিকেল বেলা , একটু একটু অন্ধকার নেমেছে , রাস্তার আলো তখনো জ্বলেনি । একটা সাইকেল এসে গেটের কাছে দাঁড়ায় । আমি বারান্দায় বসে – ‘ কে ? ’ গেট খুলে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে । উঠে গিয়ে বাইরের আলোটা জ্বেলে --- বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে । একরাশ এলো মেলো শুষ্ক চুল , খালি গায়ে সাদা থান পরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে সোনাই । কিছু বলার আগেই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে । হাত ধরে বারান্দায় বসিয়ে –‘ কি হয়েছিলো ? ’
‘ মাঝে মাঝে পেটে ব্যথা হত । সরকারি হাসপাতালের ওষুধ খেত । তাই নিয়েই রোজ সকালে বাবুদের বাড়িতে কাজে যেত । ’
বলত – ‘ তুই ভাল করে কাজ কর । বোনটার ভাল করে বিয়ে দিতে হবে । তারপর তোর । তখন আমি আর কাজ করব না । ’
‘ এখন বোনটাকে নিয়ে !!!! ’ – এতক্ষণে চোখের জল শুঁকেয়ে গেছে । চিন্তার ভাঁজ কপালে । হঠাৎ উঠে পড়ে –‘ যাই বাবু , পাড়ার কাকিমারা বলছিল বামুন ডেকে মায়ের ঘাট কাজ করতে ।নাহলে মা-নাকি মরেও শান্তি পাবেনা । আমি তো কিছু জানিনা । ওরা যা বলবে ’
‘ কেন , বাবা আছে তো ? ’
মুখটা নিচু করে চুপ করে থাকে । বুঝতে পারি এর পরের প্রশ্ন অবান্তর । হয়ত ওর বাবা আছে , হয়ত বা নেই । অন্য কোথাও , অন্য কারও সঙ্গে । এইটুকু বুজতে পারি মায়ের মৃত্যুর পরে ছোট্ট বোনের অসহায় হাত ধরে ও একা দাঁড়িয়ে । মানি ব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বার করে- ‘ এটা রেখে দে , মায়ের কাজে লাগবে । ’
মাথা নিচু করে প্রণাম করতে এলে বাঁধা দিয়ে – ‘ এসময় প্রণাম করতে নেই, মা কষ্ট পাবে ।’
ও সাইকেলের দিকে এগিয়ে যায় । ‘ খবরের কাগজের কাজ টা ছেরনা , কেমন । মায়ের কাজ হয়ে গেলে দেখা করো ।’
‘ আচ্ছা বাবু । ’ সোনাই চলে যায় । মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত । ছোটবেলায় “অভাগীর স্বর্গ” পড়ে খুব কষ্ট হয়েছিল । আজও সোনাইএর মত কত অভাগীরা একা অসহায় দৃষ্টি মেলে মায়ের স্বর্গ যাওয়া দেখে আর বলে – “মা তুমি সুখে থেকো । ”