বকখালি - অরিজিত শীল
ভারতের ২৮% আর বাংলাদেশের ৬২% মিলেই সুন্দরবন। এশিয়ার সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা গড়ান বনভূমি। আমার অনেক দিন ধরেই ইচ্ছে হচ্ছিল সুন্দরবন দেখার কিন্তু কোন না কোন কারনে তা সম্ভব হয়ে উঠছিল না । একবার হাতে দিন তিনেকের মত সময় পেয়ে ভাবলাম কোলকাতার কাছে পিঠে কই যাওয়া যায়?সময় কাটানোর জন্য পার্কস্ট্রীট এর ফুটপাথের দোকান থেকে যে সানন্দা ম্যাগাজিন টি কিনেছিলাম সেখানেই দেখলাম বক খালি ভ্রমনের আমন্ত্রন।
সে রাতেই সিদ্ধান্ত নিলাম হাতে যেহেতু তিনদিনের সময় আছে সে সময়টুকু আমরা বক খালি ভ্রমনে যাবো। যেই ভাবা সেই কাজ পরের দিন এ যাওয়া ঠিক করলাম। সেবার আমরা উঠেছিলাম হোটেল ভি আই পি কন্টিনেন্টাল এ।রাতে খেতে নেমে ম্যানেজার এর কাছ থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম। পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম বাস স্ট্যান্ড এ। ধর্মতলা থেকে প্রতিদিন বক খালির বাস ছাড়ে। টিকেট কেটে তিন জন উঠলাম ভূতল পরিবহণের বাসে। বাস ছাড়ল বেলা দুইটার দিকে। শহরে ট্রেন আর ট্রেন ভ্রমণ আমার যতোটা ভাল লাগে ততটুকুই বিরক্ত হলাম এই বাসটাকে দেখে। একদম আন্তঃজেলা বাসের মত না । মুড়ির টিন মনে হচ্ছিল । বক খালি সুন্দরবনের কাছে সমুদ্র তীরবর্তী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বদ্বীপ গুলোর মাঝে একটি ।
কলকাতা ছাড়ার পর রাস্তাগুলোর চেহারা একটু একটু করে পালটাতে লাগলো ।ডায়মন্ড হারবার এর কাছে এসে মনে হল এ যেন আমার অনেক দিনের চেনা। এটা কলকাতার কাছেই এক উপশহর।দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটি কলকাতা আর এর আশেপাশের অধিবাসীদের সপ্তাহান্তের ছুটির দিনে বেড়ানোর জন্য এক আদর্শ স্থান এবং অনেক জনপ্রিয় ।বাস থেকে দেখলাম বড় বড় ঢেউ গুলো তীরে আছড়ে পড়ছে। মোহনার কাছে নদী অনেক উত্তাল থাকে।
বিকাল বিকাল আমরা পৌঁছলাম হাতানিয়া দুয়ানিয়া নদীর পাড়ে । এখন ভ্যাসেল বা ফেরির জন্য অপেক্ষা। কিছুক্ষন লাইন এ দাড়ানোর পর আমাদের বাসটির সুযোগ আসলো ফেরিতে ওঠার। ছোট্ট ফেরি করে পার হলাম নদী ।
পথে পেলাম কাকদ্বীপ ।কিন্তু সেখানে কাকের সমাহার চোখে পড়লো না । বাস ছুটে চলছে হু হু করে। দুপাশে গাছপালা বাড়িঘর সব পিছনে ফেলে । আমাদের সহযাত্রীরা সবাই দেহাতি ।নিজেদের ছাড়া আর কোন শহুরে মানুষ দেখলাম না ।অনেক্ষন হল নদী পার করেছি। আসার আগে শুনেছিলাম ছয় কি সাড়ে ছয় ঘণ্টার পথ অথচ তখন সাতটা বাজে। বাসের কন্দাক্তার কে জিজ্ঞেস করাতে বলল বকখালি শেষ স্টপেজ একটু সময় লাগবে।
সময় যেন শেষই হচ্ছিল না ,রাত বাড়ার সাথে সাথে আমাদের অস্বস্তিও বাড়ছিল । নিজে থেকেই উপযাচক হয়ে এক মহিলা বলল তোমরা কলকাতা থেকে এসেছ বুঝি ,চিন্তা কর না আর তিনটা স্টপেজ পরেই বকখালি। অবশেষে রাত দশটা চল্লিশ কি পয়তাল্লিশ এ আমরা বাস থেকে নামলাম ।
আশেপাশে বেশ কিছু হোটেল আর পশ্চিমা পর্যটকদের দেখে ভয় আর অস্বস্তি কাটল। বাতাসে কেমন এক জলো গন্ধ ভেসে আসছিল । সমুদ্র,পাহার অথবা বন যে অঞ্চল ই হক না কেন এদের আলাদা একটা ঘ্রান থাকে।
ভ্যান গাড়িতে চরে রওয়ানা দিলাম বকখালি পশ্চিম বঙ্গ সরকারের ট্যুরিস্ট লজ এ। পাঁচ কি ছয় মিনিটেই পৌঁছে গেলাম লজ এর গেটে ।
ভ্যান চালক নিজেই অফার করল যে সে আমাদের কাল সারাবেলা ঘুরাতে চায়। আমরাও রাজি হয়ে তাকে সকাল সাড়ে আঁটটার মধ্যে চলে আসতে বললাম।
অন্ধকারে তেমন একটা কিছু না দেখা গেলেও বুঝতে পারছিলাম এলাকাটা বিশাল। লম্বা করিডোর পার হয়ে অফিস এর দায়িত্বরত ব্যাক্তির সাথে কথা বলে রুম এ উঠলাম।
সত্যি বলতে কি রুম এ ঢুকেই মনটা ভাল হয়ে গেল। অনেক প্রশস্ত ,পরিচ্ছন্ন আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ। খাবারের অর্ডার দিয়ে এক একেক জন করে স্নান করে নিলাম। ভাত আলুভাজা ডাল আর চাটনি দিয়ে রাতের খাবার খেয়েই ঘুম।
সকাল বেলা ঘুম ভাঙল কিসের যেন শব্দ হচ্ছিল। সঙ্গী দুজন তখনও ঘুমে বিভোর ।আমি আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে বাইরে বারান্দায় বের হয়ে এলাম।
প্রথমে বুঝতেই পারিনি কি দেখছি পরে যখন বুঝলাম পড়িমরি করে দৌড় দিলাম ক্যামেরা আনতে। সামনে লজ এর পুরো আঙ্গিনা সাদা হয়ে আছে । একসাথে এত বক আমি আগে আর কখনোই দেখি নাই। ওপাশ থেকে একজন হেটে আসছিল আর আমার দরওয়াজার শব্দে সবগুলা বক পাখা ঝাপটিয়ে উড়ে পালাল ।
কি আর করা সিঁড়ির উপর বসে থাকা দুই শালিকের ছবি তুলেই ক্ষান্ত দিলাম । আঙ্গিনায় ছোপ ছোপ জোয়ারের জল। প্রতিদিন দুই বেলা জোয়ারের পানিতে ভেসে যায় লজ এর আঙ্গিনা ।
যাই হোক বক এর ছবি তুলতে না পারলেও বকখালি নামকরণের কারন টা খুজে পেলাম । বারান্দা ধরে হেটে হেটে এগিয়ে গেলাম। লজটার শেষ মাথায় দেখলাম গোলপাতা আর নানা রকমের গাছের সমাহার।
রুম এ গিয়ে দেখি ওঁরা তখন ও ঘুমাচ্ছে ।ডেকে তুললাম আর গেলাম টিফিন খেতে। সকালের আলোতে ভাল করে দেখলাম পুরো এলাকাটা। অনেকখানি জায়গা জুড়ে এই লজ ।
রুম থেকে কিছুটা দূরে রেস্টুরেন্ট । সাদামাটা কিন্তু সতেজ আর সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায় এখানে । রেস্তরাঁর বাইরে ডিঙ্গি বাধা ছিল। টিফিন খেয়ে আমরা গেলাম ওখানে, জোয়ারের জল নেমে গেছে তাই ডিঙ্গিটা কাঁদার মাঝেই ছিল।
ভ্যান চালক ঠিক সকাল সকাল হাজির হয়েছে। লজ্জা পেলাম সময় মত বের হতে পারিনি বলে। ওঁর নাম রঞ্জন নিয়োগী ।কাছেই থাকে ।
শুরুতে গেলাম আমরা বক খালি বিচ এ ।বেশ নির্জন ।আশেপাশে জেলে আর স্থানীয় কয়েকজন মহিলা ছাড়া তেমন কেউ নেই।
একই সাগর ছুঁয়ে গেছে বাংলাদেশ আবার এইখানেও সেই একই সমুদ্রের পানি। তবে বাংলাদেশের কক্সবাজার এর সৈকতের বালু অনেক সুক্ষ আর এখানকার তট একটু ভারী বালু আর কাদায় মাখা ।
কিছুক্ষণ জলে পা ভিজিয়ে আসলাম এক চায়ের দোকানে। চা না খেয়ে খেলাম ডাব । পাশেই সামুদ্রিক শামুক ঝিনুক এর গয়না আর শাঁখ এর দোকান ।আমি একটা ভাল দেখে শাঁখ কিনলাম। যেখানে বেড়াতে যাই সেখানকার একটা ডেকোরেশন পিস কেনা আমার শখ । পরবর্তীতে সেগুলো আমায় ওই দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয় ।
বেলা বেড়ে গেছে ততক্ষণে তাই আমরা আবার লজ এ গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রওয়ানা দিলাম ফ্রেজারগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে ।ভ্যান এ চড়ে ঘুরার মজাই আলাদা । মেঠো পথে চলতে চলতে হঠাত দেখি ঘাসের মাঝে এক সবুজ সাপ।ভয়ে চিৎকার করে ভ্যান এর উপর পা তুলে বসলাম ।
বক খালি থেকে ফ্রেজারগঞ্জ যাবার পথে রাস্তার দুপাশে দেখি উইন্ডমিল । অবাক ব্যাপার হল এখানে পাখিরা মানুষকে ভয় পায় না। নির্বিঘ্নে খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে রাস্তায় । ওঁরা আমাদের মত রাস্তায় রাস্তায় পাখিদের পা ঝুলিয়ে বিক্রি করে না বলেই হয়ত ওঁদের সাথে পাখিদের এত সখ্যতা ।
আমরা প্রথমে গেলাম বেনফিস হারবার এ। জেলেরা মাছ ধরার নৌকা নিয়ে সাগরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।চারপাশে মেছো গন্ধ।
মাঝিরা আঙ্গুল তুলে দেখাল ওই যে ওদিকে বাংলাদেশ।
চারপাশে ঝোপঝাড় আর জলাভূমি । দূরে দেখা যায় বনের সারি ।
পোতাশ্রয় ঘুরে আমরা গেলাম কুমিরের প্রজনন ক্ষেত্র দেখতে । এবার এখান থেকে সরাসরি দেখলাম দূর দিগন্তে বাংলাদেশের সুন্দরবনের অংশ।
জায়গাটা ঘেরাও করা সংরক্ষিত অঞ্চল ।দূরে দেখলাম হরিন এর দল জল খেতে এসেছে। আমরা তো চরম পুলকিত। আর তখনি ঘটলো বিপত্তি। হাত থেকে পরে গেল ক্যামেরা ।অনেকগুলো ছবি নষ্ট হয়ে গেল।
মন খারাপ করে গেলাম ফ্রেজারগঞ্জ বিচে ।এখানে লোকজনের ভীর তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি । সন্ধ্যার কিছু পর ফিরে এলাম লজে ।
ফ্রেশ হয়ে দিলাম এটে লম্বা ঘুম । রাতের খাবার এর সময় রেস্তরাঁর টিভিতে দেখি পরের দিন পশ্চিম বঙ্গ বনধ ।আমাদের তো আক্কেল গুড়ুম ।কারন পরের দিন এর পরের দিন আমাদের কানেক্টিং ফ্লাইট। কি করা যায় এই চিন্তায় খাওয়া শেষ। ম্যানেজার নিষেধ করলেন এই রুটে রাতে ট্রেন এ যেতে ।শেষে উনি গাড়ি ঠিক করে দিলেন ।দুই ড্রাইভার আর আমরা তিন জন রাত সাড়ে নয়টায় সুন্দরবনের ধার থেকে রওয়ানা দিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে । গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর রাতের নিস্তব্ধতা সব মিলিয়ে সে এক ভয় আর রোমাঞ্চকর যাত্রা ।
ভোর রাতে পৌঁছলাম কোলকাতাতে।
সেইদিনটা ছুটি নিলাম সব কাজ থেকে স্মৃতিগুলো পুনরাবৃত্তি করার জন্য।
আশা করছি ভ্রমন কাহিনিটা পাঠকদের ভাল লাগবে।
ধন্যবাদ।