আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : আমার অহংকার - ANKUR KUNDU
“বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠানে ঝরে
রোদ , বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন ৷”
- শামসুর রহমান
মাতৃভাষারূপে বাংলাভাষা বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরের কোণে এভাবেই দীপ প্রজ্জ্বলন করেছিল ৷ যে ভাষা ‘হাসি সুখী’-এর ছড়ার মিলনে একদিন শৈশবমনে প্রথম পরিচয়টুকু করে গিয়েছিল , আজ বাংলার উদার চিরহরিৎ প্রকৃতিতে , বাউল বা ফকিরের তারের সুরে তা সর্বদায় ব্যাপৃত ৷ এই কারণেই বাঙালীর মানসিক পোতাশ্রয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাবাহী জাহাজ ফিরে ফিরে আসে ৷ তবে বর্তমানকালে ইতিহাস অনুসরণ করে পোতাশ্রয়টি আংশিক ধ্বংসের পথে ধাবমান ৷ জীবনের কোনোকিছুই দীর্ঘস্থায়ী নয় ৷ তবে বিজ্ঞানের ধারানুযায়ী বাংলাভাষাকে ই=এম্ সি^২ (ই=এম্ সি*এম্ সি) সূত্রে আবদ্ধ রাখতে পারলেই ভালো হত ৷ যদি বাংলাভাষা অবিনশ্বর হত এবং বাংলাভাষার সৃষ্টি ও ধ্বংস না হত , তবে অন্ততপক্ষে বাংলাভাষাতে প্রযুক্তিগত ‘এস্.এম্.এস্’ ভাষা প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন করতে পারত না ৷ কিন্তু এ ভাবনা সফল হবেও না ৷ বাংলাভাষায় যে সকল অপদ্রব্য মিশে গেছে , তা দূরীকরণের জন্যই ২১শে ফেব্রুয়ারীর রক্তাক্ত দিনটিকে আজ পুনরায় স্মরণ করার প্রয়োজন অনুভূত হয় ৷
জীবনের ঊষাকাল থেকে মানুষের শিক্ষা শুরু হয় ৷ জীবনের প্রথম মঞ্চই হল শৈশব ৷ মাতৃভাষা শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাকে শাখায়-প্রশাখায় , জ্ঞান-বুদ্ধিতে , সামাজিক সংস্কৃতিতে বিকশিত করে ৷ রুশো , ফ্রয়েবল্ , মন্তেসরী , স্বামী বিবেকানন্দ , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ মহান জীবনের অধিকারীগণ মানুষের সামগ্রিক বিকাশের জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন এবং বলা বাহুল্য তাঁরা মাতৃভাষাকে এই প্রয়োজনীয়তায় ‘অন্ধের যষ্ঠি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন৷ মহাত্মা গান্ধীর বুনিয়াদী শিক্ষাব্যবস্থা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছে ৷ বর্তমান সমাজে আস্থাভাজন হওয়া ততই দুরূহ যতটা একটি মশার কাছে দুরূহ জোরালো হাওয়ার সামনে নিজের ডানা ধরে রাখা ! মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা তখনই বাড়বে যখন তাদের মননে নিজেদের কার্যকারিতা সম্বন্ধে আস্থা বাড়বে ৷ ব্যক্তির রাজনৈতিক মননের বিকাশে , ধর্মীয় ঐক্যবদ্ধতার মুষ্টিবন্ধনে , দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রতি আস্থা আনয়নে মাতৃভাষাকে প্রসারিত করার প্রয়োজনও আছে ৷ জাতির নিজের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা , জাতির জাগরণে মাতৃভাষা একটা অখন্ডতা নিয়ে জাতির মধ্যে দেশাত্মবোধের অনুভূতি প্রদান করে ৷ অখন্ডতা ও প্রকান্ডতার বিভেদ বোধহয় এখানেই প্রকট হয়ে ওঠে ৷ প্রকান্ডতায় অভাবের ভাববোধ থাকা অস্বাভাবিক নয় ৷ কারণ প্রকান্ডতা তৈরী হয় বিভিন্ন বিরূপজাতীয় জিনিসের সংমিশ্রণে ৷ অখন্ডতায় থাকে একটি পূর্ণ রূপ ৷ প্রশ্নটি এখানেই যে , বাঙালী তার বাংলাভাষাকে অখন্ডতায় নাকি প্রকান্ডতায় দেখতে চায় ? এই প্রশ্ন দূরীকরণের জন্য দরকার মাতৃভাষার প্রতি এক চিলতে ভালোবাসা এবং এক পশলা শ্রদ্ধা ৷ এক চিলতে রোদ দিয়ে যেমন সমগ্র দিনের প্রথম আলো জ্বলে ওঠে , এক পশলা বৃষ্টি যেমন সূচনা ঘটায় মন ভালো করা বর্ষা , ঠিক সেরকমই এক চিলতে ও এক পশলা নিয়ে শুরু করে আমাদের মাতৃভাষা আরও বৃহৎ হবে ৷
মাতৃভাষা হল মাতৃদুগ্ধ ৷ প্রত্যেক মায়ের সন্তান শৈশবে সেই স্বাদ পেয়েছে শান্তিতে ৷ শৈশবকালে শিশুর শরীরের বিকাশকে পুষ্ট করে মাতৃদুগ্ধ এং মনের বিকাশকে পরিপুষ্ট করে মাতৃভাষা ৷ মাতৃভাষা একটি সংস্কৃতিপূর্ণ দেশের সংস্কৃতিবান মানুষের সামাজিক বৈশিষ্ট্য , সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য , ভ্রাতৃত্ববোধকে এবং আত্মিক বন্ধনকে সমাদৃত করে ৷ মাতৃভাষা ও মাতৃদুগ্ধের মধ্যে একটি পার্থক্য বর্তমান ৷ মাতৃদুগ্ধ পাওয়ার মধ্যে কোনো সংগ্রাম থাকে না , পরিবর্তে একটি নিষ্পাপ দৃশ্য পাওয়া যায় ৷ কিন্তু মাতৃভাষার জন্য বিভিন্ন দেশে অনেক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছে , অত্যাচারীর নিষ্পেষণে বিলীন হয়েছে অনেক বজ্রকন্ঠীর অন্তিম আর্তনাদ ৷ বাংলাদেশে মাতৃভাষা স্বীকৃতির জন্য ১৯৫২সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ছাত্রমৃত্যুর করুণ অথচ ঐতিহ্যমন্ডিত দিনকে বাংলাদেশে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার আহ্বান জানানো হয় :“আমার ভাই-এর রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী/সে কথা কি জীবনে মরণে কখনো ভুলিতে পারি ৷” পরবর্তীকালে বাংলাদেশসহ সরা বিশ্বে এই দিনটিই “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস”-রূপে পালিত হয় ৷ দিনের শেষে যে গোধূলিবেলা মোহময়ী রজনীকে আহ্বান করে এবং তখন আমাদের একটি সুন্দর নিদ্রাকাল উপহার দেয়, সেই গোধূলিবেলার রাঙা আভা কি কখনও ভুলে থাকা যায় ! কখনও কোনো সন্তান ‘মা’ উচ্চারণ করেনি , তা কি কখনও হয়েছে ! তেমনই ১৯৫২-র সেই দিনটির রক্ত কি এত তাড়াতাড়ি শুকোতে পারে ! প্রতি বছর সারা বিশ্ব আপামর জনসাধারণের কথা মনে রেখে এই দিনটি শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে চলেছে ৷
যারা সদ্যোজাত তারা ২১শে ফেব্রুয়ারীর মাহাত্ম্য একদিন ঠিকই বুঝবে ৷ কিন্তু , যারা এই দিনটি সম্বন্ধে সদ্যজ্ঞাত , তারা কি কোনওদিন বুঝবে কেন ২১শে ফেব্রুয়ারী একটি সাধারণ তারিখ নয় ! কেন ২১শে ফেব্রুয়ারী শাশ্বতী ! এইসকল মানুষজনের উদ্দেশ্যে আমার এই তথ্য:- ২১শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্যে রয়েছে বাঙালীর সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি ও বাংলাভাষার প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ৷ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষকে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দুইভাগে ভেঙে গড়ে তুলেছিল মুসলিম-ভারতবর্ষ এবং অ-মুসলিম-ভারতবর্ষ ৷ বর্তমানে যে রাষ্ট্রটি ‘বাংলাদেশ’ নামে বিশ্ব মানচিত্রে যোগ্য স্থান দখল করে আছে , তার তখনকার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান ; যার রাষ্ট্রীয় ভাষা ঊর্দু ৷ যদিও ঊর্দু তখন কোনো অঞ্চলেরই মাতৃভাষা ছিলনা ৷ মোট জনসংখ্যার ৫৬শতাংশ ছিল বাংলাভাষী মানুষ ৷ অধিক সংখ্যক মানুষের কথ্য ভাষা ছিনিয়ে নিয়ে বাংলাভাষীদের ওপরে বলপ্রয়োগে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ঊর্দু ভাষা ৷ ১৯৪৮সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী প্রয়াত
শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় ঊর্দু ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা স্বীকৃতি দানের বিরূদ্ধে সোচ্চার হন ৷ তখন থেকেই মাতৃভাষায় কথা বলার স্বাধীনতা লাভের সার্বজনীন প্রচেষ্টার উড়ন্ত ধ্বজা ধীরে ধীরে নিজের জৌলুস বাড়িয়ে চলেছে ৷ ১৯৫২সালে ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে এই ধ্বজা প্রতিটি মানুষের মনে জায়গা করেছিল , তারপর তাদের মননে জমতে থাকা বিদ্রোহের আগুনের তেজ পদ্মা-যমুনা-মেঘনা নদীর তীরে জন্ম দিয়েছিল এক উদ্ধত আন্দোলনের ! যদিও নদীমাতৃক বাংলায় নদীর জল সেদিন যেন ‘জল না ওরা অশ্রু ধারা’-য় পরিণত হয়েছিল , রক্তদানের মহিমায় ৷ একটি আন্দোলন যে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট চাহিদার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে , তা নয় ; বরং , একটি নির্দিষ্ট চাহিদার পাশাপাশি মাথা তুলে দাঁড়ায় বেশ কিছু ‘সাব-প্লট’ ৷ যেগুলি কেবল অর্জন করার আশায় নয় , পরিবর্তে ঐ নির্দিষ্ট চাহিদার লেলিহান শিখাকে আরও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে জ্বলতে সাহায্য করে ৷ পরবর্তীকালে এই ‘সাব-প্লটগুলি হয়ে ওঠে এক-একটি স্ফুলিঙ্গ , যা শুধুমাত্র কিছু অগ্নিকণা , কিন্ত প্রতিটি অগ্নিকণা বিশাল ক্ষমতার অধিকারী ৷ এরা ১৯৪৭-এ একবার ইংরেজ সরকারের সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে প্রতিটি অংশ পুড়িয়ে দিয়েছিল ৷ এরপর ১৯৫২-তে সেই স্ফুলিঙ্গই মানুষের মুখে মুখে স্বাধীন ভাষা ফুটিয়েছিল ৷ একটি সমগ্র জাতির সংগ্রামের অনুপ্রেরণা কোনোদিন বিস্মরণের আঁধার রাতে অস্তমিত হয়না ৷ কারণ , জাতির জন্ম এক বছর বা দশ বছরে হয়না ৷ এটি একটি চলমান প্রবাহ ৷ যুগ যুগ ধরে এই গতি তার ক্ষিপ্রতা বজায় রেখেছে ৷ কোথাও হোঁচট খেয়েছে , কোথাও চিন্তার রেখা ললাটে নিয়েই ভাসিয়েছে মানব-সংস্কৃতি এক অজানা সীমাহীন পথে , যে পথে সাহায্যের জন্য দূরদর্শীসম্পন্ন কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তি নেই ৷ জাতির যেমন মৃত্যু হয়না , সেরকমই মাতৃভাষাও চিরবিরাজমান ; কিন্তু যে সংগ্রামের মাধ্যমে এই অমর সৃষ্টি , সেই সংগ্রামকে সম্মান জানানোর জন্যই ২১শে ফেব্রুয়ারী অতীতের ইতিহাসে ও ভবিষ্যতের অমরত্বে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে পালিত হয়েছে এবং বারংবার হবে ৷
আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ আমাদের সহোদরদের বুকের রক্তে রাঙানো মাতৃভাষা দিবসের অঙ্গীকার আজও প্রতিটি মানুষের বুকের হৃৎস্পন্দনের মতোই ধাবমান ৷ নাস্তিকেরা হয়তো কোনোদিনই ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস রাখবেনা ; কৃষকেরা হয়তো বর্তমান ফলনের ভরাডুবি দেখে আগামী ফলনের ওপর ভরসা না রেখে আত্মহত্যা করবে ; কিন্তু মাতৃভাষার প্রয়োজন তাদের সকলের জীবনে থেকে যাবে আমৃত্যু অথবা মৃত্যুর পরেও ! ‘কফি হাউসের সেই আড্ডা’-তে বাংলাভাষার প্রতি মমত্ববোধ দেখিয়েছিলেন বিখ্যাত মানুষেরা ৷ আজ হয়তো কফি হাউসের দেওয়ালের যত্ন ঠিকমতো নেওয়া হয়না ; নাহলে সেইসব শোনা যে দেওয়ালে কান পাতলেই ৷ এখনকার ফ্যাশন্-পাগল যুবকেরা ফ্লুরিজে বাংলা-ইংরাজী-হিন্দী ভাষার মিশ্রণে হয়তো নতুন ভাষা বকবক করতে চায়ছে ; কিন্তু তারাও তো বাড়ি ফিরে বলে ‘মা ! ভাত দাও !’ ; বিখ্যাত পাশ্চাত্য দার্শনিক জর্জ বিশপ্ বার্কলে বলেছিলেন “অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ-নির্ভর” ; কিন্তু আমরা যদি এই কথাটির সমগ্র অর্থে সরলীকরণ করি , তাহলে তো বলতে হচ্ছে যে , আমরা নির্জীব যুক্তিকে ত্যাগ করে অস্তিত্বহীন মাতৃভাষাকে নিজেদের হৃদয়ে মেলে আঁখিপল্লবে নতুন স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ বানিয়েছি , যেখানে আমরা সকল ‘আমি’ এবং আমাদের মাতৃভাষাকে নিয়ে কবির মতো বলতে পারি:
“আজন্ম আমার সাথী তুমি ,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে
তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে
আমারই বন্দরে৷”