ঝরাপাতা - Satyahari
পরি এই পৃথিবীতে আমার দেখা সবচেয়ে মিষ্টি মেয়ে । না না পরি আমার প্রেমিকা নয় আপনারা দয়াকরে পরির মতো একটা সুন্দর মেয়ের সাথে আমার মতো এক জন কুদসিত কদাকার মানুষকে ভুলকরেও জড়াবেন না । পরি হল আমারমত একজন অখ্যাত লেখকের আনামি গল্পের সবচেয়ে দামি নায়িকা ।
ঘটনাটা আজথেকে ১২ বছর আগের, গ্রামের নাম বসন্তপুর। এই বসন্তপুর গ্রামটি আর পাঁচটা বাংলার গ্রামের মতো না । তখন ও সেই বসন্তপুর গ্রামে জমিদারের রাজত্ব ছিল। কথিতআছে সেই নন্দ বংশের রাজত্বকাল থেকে এই বসন্তপুর গ্রামে চৌধুরিরা জমিদারি করে আসিতেছে। গল্পের সুবিধায় আমি আপনাদেরকে বসন্তপুরে নিয়ে চলে যাচ্ছি।
রাজনারায়ন চৌধুরি জন্মসূত্রে তিনি এখন এই বসন্তপুর গ্রামের জমিদার । তার এই সুবিশাল জমিদারির অঘিকৃত গ্রামের এক্কেবারে শেষপ্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী পলাশ । এই পলাশ নদী বসন্তপুর গ্রামটাকে যেখানটায় ছুঁয়ে শিমুলপুর গ্রামের দিকে চলেগেছে ঠিক সেইখানটায় এক ছোট্ট মাটির কুঁড়ঘরে বাবার সাথে বাসকরে আমার নায়িকা ক্ষমাকরবেন আমার গল্পের নায়িকা পরি । পরির মা মারাগেছেন ৫ বছর আগে একটা অজানা অসুখে । পরির বাবা খুব গরীব তাই পরির মায়ের চিকিৎস্যা করতে পারেনি । পরির বয়স এখন ১২, ঠিক যে বয়সটায় আর পাঁচটা মেয়ে পড়াশোনা, খেলাধুলা করে বাবা মায়ের আদরে জীবন কাটায় পরির বেলায় কিন্তু সেটা হয়নি । পরির বাবা জমিদারের বাড়িতে চাষের কাজ করে আর পরি জমিদারের একমাত্র বাচ্চাছেলেটাকে দেখাশোনা করে বিনিময়ে দুবেলেয়া দুমুঠো খাবার পায় । আমার বাবা ছিলেন কৃষিবিভাগের একজন পদস্ত অফিসার । বাবার বদলিসূত্রে আমার ওই গ্রামে যাওয়া । আমার বাবা যেহেতু ওই গ্রামের অতিথি তাই স্বভাবতই জমিদার বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল, আর ঠিক সেখানেই আমি আমার নাইয়কাকে প্রথম আমি দেখতে পাই একটি ছোট্ট ছেলেকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে আপনমনে খেলাচ্ছে । প্রথম দেখাতেই তাকে আমার খুবভালো লেগে গেল । তখন আমার ও বয়সটা খুব কমছিল তাই বুঝতে পারিনি ওটা ঠিক কি ছিল প্রেম না কি অন্যকিছু ? আস্তে আস্তে পরি আমার খুব ভাল বন্ধু হয়েগেল । একদিন যদি ও জমিদার বাড়িতে না আসত তাহলে আমার কিছুই ভাললাগতোনা । আমি লুকিয়ে তারজন্যে খাবার নিয়ে যেতাম, আমার খেলনাগুলো তাকে দিয়ে দিতাম, আর আমার পরি যে সেই খেলনাগুলো পেয়ে কি খুশি হত তা এই পৃথিবীতে আমি ছারা আর দ্বিতীয় কেউ জানেনা । তোমরা কেউ আমার পরিকে স্বাথ'পর ভেবনা পরি ও আমাকে ভালোবেসে এনে দিত মুঠোভতি' শিউলি ফুল, কখনওবা নাম না জানা জংলি কোন ফুল । পরি আমাকে ভালোবেসে বন্ধু বলে ডাকতো আর আমি শুধুই '' পরি " । এই শহুরে ভীড়ের মাঝখান থেকে ওই গ্রামে না গেলে আমি কোনদিনই এই বাংলার আসল রুপটি খুঁজে পেতাম না । পরি রোজ আমাকে ওই গ্রামের নতুন নতুন জায়গায় নিয়ে যেত বেড়াতে । ও খুব মিষ্টি সুরে গান ও গাইতে পারত । আমি সারাক্ষণ শুধু পরির মিষ্টি মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম । ওর সেই সরলতা, হাসি, গান, ছুটেবেড়ানো আমি সারাক্ষণ বসে বসে দেখতাম আর ও এসে আমার কানে ঘাসের ফুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে যেত । পরি যেন আমার বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস হয়ে গিয়েছিল যাকে ছাড়া আমার একমুহূর্ত ও বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল । আমার অজান্তেই ও আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে উঠেছিল ।
আজ সকাল থেকেই জমিদার বাড়ীতে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেছে কারন আজ জমিদার বাবুর একমাত্র ছেলের প্রথম জন্মদিন তাই পাশাপাশি সাতগ্রামের নামকরা লোকদের কে খাওয়ানো হবে । ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে কিন্ত আমি কিছুতেই আমার সেই নয়নমণি, জমিদার বাবুর ছেলের সব্ব'ক্ষনের খেলার সঙ্গিনী টি কে খুঁজে পাচ্ছি না । তাকে একটিবার দেখার জন্যে আমার মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল । আমি দৌড় লাগালাম পরির বাড়ীর দিকে । দেখলাম সেই বকুল ফুলের গাছটার তলায় যেখানে বসে আমরা সারাক্ষণ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতাম ঠিক সেখানটায় বসে পরি অঝোর ঝরে কেঁদে চলেছে । আমি থমকে দাঁড়ালাম আর পরি বলে ডাকলাম, পরি আমাকে দেখে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আরও বেশী কাঁদতে লাগল । আমি আমার দুহাত দিয়ে ওর চোখ দুটো মুছে দিয়ে ও কেন কাঁদছে জিজ্ঞেস করলাম । পরি বলল জমিদার বাবু তাকে বলেছে যে আজ তাঁদের বাড়ীতে সব বড় বড় লোকে আসবে তাই সে যেন জমিদার বাড়ীতে না যায়, কিন্তু ও জমিদার বাবুর ছোট্ট ছেলেটিকে একবার না দেখলে ও থাকতে পারে না । আমি পরির হাতটা ধরলাম আর দৌড় লাগালাম জমিদার বাড়ীর দিকে ।
জমিদার বাড়ীতে চারিদিকে লোক থিক থিক করছে, আমি লুকিয়ে পরিকে নিয়ে জমিদার বাড়ীতে ডুকলাম । দেখলাম দোলনায় শোয়ানো আছে জমিদার বাবুর ছেলেকে । কিন্তু কখন যে পরি তার হাতটা আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওই দোলনার দিকে দৌড়ে গিয়ে কোন একজনের হাত থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে আমি টা খেয়াল করিনি । পরি বাচ্চাটাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে দেখে কিছুজন বাচ্চা চোর বলে দৌড় দিয়েছে তার পেছনে । আমি ও সেই দৌড়ে দৌড় শুরু করলাম কিন্তু কিছুদুর যাবার পর আমি লক্ষ করলাম জমিদার বাবুর সদর দরজার কাছে পরিকে ধরে ফেলেছে জমিদার বাবুর দারোয়ানরা । বাচ্চাটিকে পরির হাত থেকে কেড়ে নিয়ে শুরু হল এক অমানবিক লাঠির খেলা যে খেলা শেষ হল আমার পরির শেষ রক্তের বিনিময়ে । জমিদার বাবুর নিদে'শে পরির নিথর দেহটাকে টেনে টেনে দারোয়ানরা সদর দরজার বাহিরে নিয়েগেল । ঠিক তখন ই কেউ আমার হাতটা ধরে ভেতরের দিকে টেনে নিয়েযেতে লাগল, আর যাবার সময় আমি দেখলাম পরির নিষ্পাপ চোখ দুটি তখনও তার এই হতভাগা বন্ধুটির দিকে তাকিয়েছিল আর শোনা যাচ্ছিল এক সদ্য সন্তানহারা বাবার কান্নার আওয়াজ যা ধীরে ধীরে জমিদারবাড়ীর উৎসবের ভীড়ের আওয়াজে হারিয়ে যেতে লাগল ।
এইভাবেই আমার বেঁচে থাকার নিশ্বাঃস আমায় ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেল । আজ এই শহরের ভিড়ে আমি শুধূ ভাবি " আমি কি সেদিন ভুল করেছিলাম ? "