বিগত দশ বছর ধরে আমরা বিরাজমান। কিছু প্রউক্তুশিল কারণে আমাদের মেইন ওয়েবসাইটটি কিছুদিন বন্ধ ছিল। আমাদের কাজ চলছে, আমরা আবার আসিব ফিরে। কিন্তু ততদিন আমাদের এতদিনের আর্কাইভটা প্রকাশ করা থাকল। অনেক পুরনো জিনিসপত্র পাবেন, যদি কারর কন আপত্তি থাকে আমাদের কে মেইল করে জানাবেন। admin@werbangali.com
আপনি যদি আমাদের e-commerce shop খুজ্জেন তাহলে এই লিঙ্ক এ ভিজিট করুন : shop.werbangali.com

চিঠিটা আজও পোস্ট করা হয়নি - দেবমানী সাহা

রাত তখন দেড়টা বা দুটো, পুরো হোস্টেলে আমি শুধু একা। রবিবারের রাত, বাইরে খুব জোরে হাওয়া বইছে। দরজার বার বার খোলা বন্ধের দুদ্দাড় শব্দ, জানলার পাশের আমা গাছের শুকনো পাতার খসখসানি - আর - আর ঘরের মধ্যে ভেসে আসা বেতার শিল্পীর মিষ্টি স্নিগ্ধ সুরেলা গলা এই মনোরম পরিবেশে কি করবো কি না করবো ভাবছিলাম, এমন সময় টেবিলটার দিকে চোখ পরতেই দেখি দুটো তিনটে সাদা পাতা পড়ে, জোরে হাওয়া বইছে জানলা দিয়ে তাই পাতাগুলো উড়ছে, ঝাপটাচ্ছে ... অনেকক্ষন পাতা গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম, বুঝলাম পাতাগুলোর ডানা ঝাপ্টানোর আবদার। এগিয়ে এসে টেবিলে রাখা পেনস্ট্যান্ড থেকে তুলে নিলাম পেনটা। টেবিল ল্যাম্পের আলোটা জ্বলতেই কাগজ গুলো যেন আমায় পেতে চাইল আমার হাতের স্পর্শ, ব্যক্ত কোরতে চাইল আমার মনের ভাবনা, ভাগ করে নিতে চাইল আমার স্বব দুঃখ্য, সব কষ্ট, সব আনন্দ, সব কিছু।
(১)
কি লিখব কি লিখব ভেবে বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। অন্ধকারে তখন টেবিল ল্যাম্পটার আলো আমায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে স্মৃতির গভীর তলে। আলো-আঁধারির উন্মাদনা ক্ষনিকের জন্য ফিরিয়ে দিয়েছিল আমার শরীরে। কানে যেন বাজছে সেই স্কুলের মাঠের চিৎকার, ক্লাসের শেষের ঘন্টা। চোখের সামনে ভাসছে বন্ধুদের সাথে আড্ডার দিন গুলোর নির্বাক প্রতিচ্ছবি। কে যেন বলছে কাছে এসে "কি রে আজ যাবি তো রেল পুকুর পাড়ে ? তোর জন্য একটা জিনিস কিনেছি......"
সেই চেনাস্বর, সেই স্পর্শকাতর হাসি, সেই হারিয়ে যাওয়া আদর মাখানো ডাক, সেই আবদারের বুলি - কোথায় গেল সব? কোথায় আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেল এরা? কোথায় গেল সেই মেঘপিত্তনের ঝুলিতে ভরা আমার স্বপ্নগুলো ?
দম বন্ধ হয়ে গেলে এই সব ভেবে। বুক চাপা অভিমান কি আমায় ফিরিয়ে দিতে পারবে এসব? পারবে আমার স্কুল পালানোর দিনগুলোকে এনে দিতে? পারবে আমার হাত ধরে ছুটিয়ে নিয়ে যেতে সেই খেলার মাঠে? পারবে আমার রেলপুকুড় পাড়ে বসে থাকা মুহুর্ত গুলো ফিরিয়ে এনে দিতে?
(২)
সাদা পাতাগুলো তখনও হাওয়ার তালে উড়ছিল। পেনটা খুললাম এবার, লিখতে বসলাম সেই চিঠি -
প্রিয়
___________,
কেমন আছিস? মনে পরছে আমায়? চিনতে পারছিস? আসলে যোগাযোগ বন্ধ হয়েছিল সেই বছর চারেক আগে। সেই পুজোর দশমীর দিনটাতে, মনে পড়ে তোর ? তারপর তো কত পুজো গেল, এল, সবই কাটালাম। একাই কাটালাম। তবে একা ঠিক না রে, সাথে ছিল আমার লেখা, আমার স্বপ্ন, আমার কল্পনা।
তোর সাথে অনেকদিন যোগাযোগ নেই, তাই আজ চিঠিটাই লিখলাম, ভাবছি ই-মেল, ফেসবুক, মেসেজ এর এই দ্রুততম যুগে আমার হাতে লেখা চিঠিটা কি তোর কাছে পৌছাবে? পাবে সামান্যতম মূল্য ? চিঠিটা আর কিছু চায় না রে, তোর দিনের এই ব্যস্ত কর্মময়তার মাঝে কয়েক মুহুর্তের বিরতির, যে বিরতিতে আমার হাতের এই লেখা তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ফেলে আসা সময়ে - দিন গুলোতে - মুহুর্তগুলোতে ...
আজ ভীষন ভাবে মনে পরছে তোর সাথে সেই নৈহাটি যাওয়ার দিনগুলো, রেলপুকুর পারে বসে থাকা সময়গুলো। বই মেলা থেকে ফুটবল মাঠ - কেমন যেন ছায়ার মতন লেগে থাকতাম আমরা। পারিবারিক সম্পর্ক নয়, ভালোবাসা নয়, প্রেম নয়, দাম্পত্যও না - তবু যেন ছিল এক অচ্ছেদ্য বন্ধন - বন্ধুত্বের বন্ধন - নিবিড় বন্ধন।
ব্যস্ত শহুরে জীবন দুটো কখন যে এতটা দুরত্ব তৈরি করে ফেলেছিল নিজেদের মধে - বুঝতেই পারিনি। জানি না রে ঘড়ির কাটার এই নিয়ম মাফিক এগিয়ে চলাটা কখন আমার জীবনটাকে তোলপাড় করে দিয়ে গেছে, ভাসিয়ে দিয়েছে আমার স্বপ্নের ভেলা, উড়িয়েছে স্বাধীনতার বিজয় উড়ান, দিয়েছে ভালোবাসা, দিয়েছে সাফল্যের পরম তৃপ্তি - আজ আমি বেতার শিল্পী - তোর সেই চৈতি ...
আর কি লিখব - কেটে যাওয়া দিন গুলোর ভিড়ে শুধুই তুই যে কখনও হারাসনি এটুকু বলতে পারি। তোর স্মৃতিতে কখনও চোখ দিয়ে জল ঝড়েছে, কখনও কবিতার প্রেরনা এসেছে, কখনও বা স্বরচিত গল্প গুলো পেয়েছে ভাষা।
বেতার সংস্থার অফিসে বসে যখন শহরের মানুষ গুলোর গলা শুনি, হাজার ফোনের ভিড়ে খুঁজি তোকে, খুঁজি তোর কন্ঠস্বর টাকে। ভাবি তোর ব্যস্ত জীবনে অনেকদিন আগেই হারিয়ে গেছি আমি, মুছে গেছে, আমার স্মৃতি, আমার অস্তিত্ব।
ভালো থাকিস, তোর কথা খুব মনে পড়ে,
বদলে গেছে সময়,
এগিয়েছে জীবন
শুধু বদলাইনি তোর স্মৃতি
মুছে যায়নি তোর স্পর্শের অনুভূতি
ভুলিনি তোকে
হারিয়ে যেতে দিইনি তোর অস্তিত্বকে

ইতি,
তোর চৈতি

(৩)
দমকা হাওয়ায় জানলাটা হঠাৎ সজোরে বন্ধ হয়ে গেল। চেয়ার থেকে উঠে খুলে দিলাম আবার। ঘরির কাঁটা তখন প্রায় তিনটে ছোঁয়, সাদা পৃষ্ঠায় নীল কালিতে লেখা শব্দ গুলো যেন আর্তনাদ করেছে আমার কাছে, ছুটে যেতে চাইছে হাওয়ার সাথে ভেসে সেই মানুষটার কাছে। জানাতে চাইছে তাঁকে দীর্ঘ চার বছর পর হঠাৎ আমার হাতের এই স্পর্শের আস্বাদন।
টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে চিঠিটা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে রাখলাম খানিকক্ষন পর। ড্রয়ারটা বন্ধ করতেই চোখ দুটো ভারী হয়ে এল, গাল বেয়ে ঝড়ে পড়ল কয়েকফোটা জল। টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে গেলাম। জানলা দিয়ে তাকালাম আকাশটার দিকে ভাবলাম আকাশটা কত নীল, কি বিশাল তার বিস্তৃতি, তার তলাতেই আশ্রয় পায় সব ঠিকানা - যেখানে পাঠাব আমার এই চিঠি - পাঠাবো আমার না বলা কথাগুলো - পাঠাবো আমার স্বপ্নগুলো, সাফল্যের হাতছানি গুলো..... টেবিলে মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। মনে আছে শুধু পোস্ট না হয়া চিঠিটার কথা, মনে আছে সেই নীল পেনে লেখা ভাষা গুলো, মনে আছে দমকা হাওয়ার চিঠির পাতা দুটোর ডানা ঝাপটানোর আর্তি, চিঠিটা আজও পোস্ট করা হয় নি।