রবীন্দ্র দর্শন ও রবীন্দ্র নাথের সাহিত্য তত্ত্ব - উজ্জয়িনী সাঁতরা
'মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয় হচ্ছে, মানুষ সৃষ্টিকর্তা।' ...
রবীন্দ্রনাথের মতে প্রত্যেক মানুষ ই স্রষ্টা, সৃজনশীল তাতেই মানুষের সত্য পরিচয়। সৃষ্টির রাজ্যে মানুষ প্রয়োজনের বন্ধন থেকে মুক্তি পায়। রবীন্দ্রনাথ তার নিজের ধর্ম কে বলেছেন শিল্পীয় ধর্ম - "দ্য রিলিজিয়ন অফ এন আর্টিস্ট" । কিন্তু রবীন্দ্র নাথের আলোচনায় শিল্পীয় ধর্ম কথাটার তাৎপর্য কেবল তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের মধ্যেই আবদ্ধ নয়। এ হল মানুষ মাত্রের ই স্বভাবগত ধর্ম, এর ই মধ্যে দিয়েই মানুষ যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে।
মানুষ স্বভাবতই শিল্পী, মানুষের সহজ স্বাভাবিক দৃষ্টি ই শিল্প দৃষ্টি । এই দৃষ্টি তে যা দেখি তাই সত্য এবং সত্য শুধু এই দৃষ্টি র সামনেই উদ্ভাসিত হয়। শিল্পদৃষ্টি ই যে সত্য কে পায়, তাঁর একমাত্র কারণ কিন্তু এ নয় যে শিল্পদৃষ্টি ই মানুষের স্বাভাবিক দৃষ্টি । গভীর তর কারণ হল সত্য নিজেই শিল্প-স্বভাব, সত্য অখণ্ড সমগ্রতা - মূর্ত সজীব সশরীরী । কথাটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু কথাটা কে রবীন্দ্রনাথ যে তাৎপর্যে নিয়ে গেছেন সেটা একেবারেই নতুন। কেন না, রবীন্দ্র নাথের অনেক খানি জোর "সত্য যে মানবিক" এই কথাটার উপরে । বিশ্ব সত্য কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'সুপার পারসোনাল ম্যান, দা ইউনিভার্সাল হিউম্যান স্পিরিট' । রবীন্দ্রনাথ মনে করেন সত্য সবসময় মূল্য- সংপৃক্ত। সত্য থেকে মূল্য কে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, সত্য সবসময় অন্তরঙ্গ, সবসময় ই আস্বাদন ধর্মী। বিশ্বজগৎ সব সময় ই মানুষের হ্রদয় রসে সঞ্জীবিত বিশ্বজগৎ যিনি এই কথা বলেন, যার কাছে বিশ্ব সত্য আড় শিল্প সত্য অভিন্ন, তাঁর দর্শন চিন্তা কখনই শিল্প চিন্তা থেকে পৃথক থাকতে পাড়ে না এবং সাহিত্য বিশেষ একটি শিল্প। সুতরাং সাহিত্য তত্ত্ব বিশেষ একটি শিল্পের ই তত্ত্ব।
সাহিত্য কথা টি কে কখন ও কখন ও তিনি তাঁর বিভিন্ন বিশিষ্ট অর্থে - ইংরাজি সাহিত্যের সমার্থক শব্দ রূপে ও ব্যবহার করেছেন, আবার কখনো কখনও সরাসরি আর্ট বা ললিত কলা অর্থে ও ব্যবহার করেছেন, রবীন্দ্রনাথের পরিভাষায় সাহিত্য অর্থ মিলন সাধন। যা কিছু মিলন ঘটায় তাই সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথের মতে , সব শিল্পের ই প্রথম কথা হল মিলন বা সহিত-ত্ব অর্থাৎ সাহিত্য। শিল্প বা সাহিত্যের যে মিলন ঘটে তা আনন্দের ই মধ্যে মিলন, আনন্দময় মিলন। এর ই নাম প্রেম, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় অমৃত।
রবীন্দ্রনাথ আগে দার্শনিক, তারপরে শিল্পতত্ত্বজ্ঞ, এমন নয় । তাঁর শিল্প তত্ত্ব সাহিত্য তত্ত্ব কোনও পূর্বগামী দর্শন কে অনুসরণ করে না, সামান্যই অত্যুক্তি হবে, যদি বলা যায় যে, এখানে শিল্প তত্ত্বই দর্শন এবং দর্শন ই শিল্প তত্ত্ব তথা সাহিত্য তত্ত্ব।
কবে একথা মনে রাখা উচিৎ যে শিল্পিত দর্শন আর শিল্প কেন্দ্রিত দর্শন এক নয়। রবীন্দ্র দর্শন শিল্পিত এবং শিল্প কেন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথের মানব তত্ত্বের মূল কথা এই যে মানুষ স্বভাবতই শিল্পী, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বতত্ত্বের মূল কথা এই যে বিশ্ব স্বরূপতই শিল্প। জগৎ নিজেই একটা শিল্প এবং সেই শিল্প মানব রচিত;
শাস্ত্রে বলেছে, "দেবস্য কাব্যম।" রবীন্দ্রনাথ তা অস্বীকার করেননি। কিন্তু তাঁর নিজস্ব বক্তব্য হলোঃ "মানবস্য কাব্যম" ।