বিগত দশ বছর ধরে আমরা বিরাজমান। কিছু প্রউক্তুশিল কারণে আমাদের মেইন ওয়েবসাইটটি কিছুদিন বন্ধ ছিল। আমাদের কাজ চলছে, আমরা আবার আসিব ফিরে। কিন্তু ততদিন আমাদের এতদিনের আর্কাইভটা প্রকাশ করা থাকল। অনেক পুরনো জিনিসপত্র পাবেন, যদি কারর কন আপত্তি থাকে আমাদের কে মেইল করে জানাবেন। admin@werbangali.com
আপনি যদি আমাদের e-commerce shop খুজ্জেন তাহলে এই লিঙ্ক এ ভিজিট করুন : shop.werbangali.com

সুন্দর অ সুন্দর - Sourav Mitra

"বাবু বেরোবার আগে বাবার ওষুধ গুলো নিয়ে আসিস।"

 

ও ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল মা। কেয়া হয়ত এর মধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসেও নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতে হবে। মা ঠিক সময়েই এই কাজ গুলো দেয়। বাবার প্রেশার, ডায়াবেটিসের ওষুধ মিলিয়ে মাসে প্রায় হাজার পাঁচেক টাকার ওষুধ লাগে। বাবা বড় সরকারি অফিসার ছিলেন, পেনসনের যা টাকা পান অনেক ইঞ্জিনিয়ার প্রথম চাকরি তে ঢুকেও অত পায়না। টাকা সবই বাবার, আমাকে শুধু আনতে হবে। আমার মনে হয় মা এগুলো ইচ্ছে করে করে, যাতে আমার গ্লানি বোধ হয়। আমি বেকার, টিউশন করে নিজের খরচা চালাই, EMI দিয়ে বাইক কিনেছি, ঘরে একটা পয়সাও দিইনা তাই মুখে এসব বলতে না পারলেও মা আমাকে এই ভাবে বোঝায় যে বাড়ির অবস্থা ঠিক কী, আমার কী করা উচিৎ, আর আমি কিছুই করিনা, বা করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা কোনটাই আমার নেই। নইলে আমার মায়ের শরীর এমন কিছু অশক্ত নয়, নিজেই গিয়ে নিয়ে আসতে পারে। 

 

ওষুধের টাকাটা আলাদা নিয়ে বেরোতে হবে, কী ঝামেলা। মোটামুটি হাজার পাঁচেক সঙ্গে রেখেছি, আমার কার্ড নিয়ে ঘোরার অভ্যেস নেই, তাই একটু ঝুঁকি নিয়ে ক্যাশ ক্যারি করতে হয়। ৫ জন মত বন্ধু থাকবে। ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের ফি, অন্য খরচা ধরেও বন্ধুদের একটু খাওয়াতেও হবে, মনে হয় এতেই হবে। আমি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তাই পড়াতামও সায়েন্স। ৯-১২ ক্লাসের ছেলে মেয়েদের সায়েন্স গ্রুপ। এখন অবশ্য নিচু ক্লাসের অল সাবজেক্ট পড়াই, সবই ইংলিশ মিডিয়াম। খাটনি কম, টাকাও বেশী পাওয়া যায়। ৩-৪ টে টিউশন বাড়ী ধরলেই মাসে ১০ হাজার মত টাকা পেয়ে যাই। কেয়াকে কিছু একটা দিতে হবে, সেটা পরের মাসে দেখা যাবে। কেয়া অত বড় বাড়ির মেয়ে, আমার ধারনা ওদের বাড়ির দারোয়ানও আমার থেকে বেশী টাকা মাইনে পায়। তবে একবার বিয়েটা হয়ে গেলে বাড়ির লোকের কিছু বলার থাকবে না, আমার ২৬ ওর ২৩। মেনে নিতে বাধ্য। দুনিয়ার আর কোনও মেয়েকেই ওর মত সুন্দর মনে হয়না, ওকে দেখলেই ভাবি "এমনটি আর পড়িল না চোখে আমার যেমন আছে"। ওরকম বাড়ির মেয়ে আমাকে ভালবাসল কী করে তাই ভাবি, মনে হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ। ওকে ভালো কিছু একটা দিতে হবে।

 

ওষুধটা কিনে ঘরে ঢুকে দেখি পিউ। আমাদের বাড়ির উলটো দিকের বাড়িতে থাকে। এরকম কুৎসিত মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। সামনের দুটো দাঁত যেন খরগোশের মতন লাগে, সব সময় বাইরে। কোনও ছিরি-ছাদ নেই, বিশালবক্ষা একটা বয়স্থা মেয়ে, একটা ম্যাক্সি পড়ে পাড়া ঘুরে বেড়ায় আর একটা পাতলা ফেলফেলে ওড়না দিয়ে রাখে। কোথায় তাড়াতাড়ি বেরবো তা না, মা ডেকে ওর মাস্টার্সের রেজাল্টের ফিরিস্তি শোনাতে লাগল। পিউ আমার দিকে হেসে বলল "কাজে বেরোচ্ছ?", আমার ইচ্ছে হল বলি "নারে ডালকুত্তি, তোকে নিয়ে ফুচকা খেতে বের হচ্ছি"। হেসে বললাম "হ্যাঁ"। ও যাওয়ার পর মা শোনাতে লাগল, দেখ বাবু মেয়েটা কী ভালো, আমার শাড়িটা তার থেকে নিয়ে এসে বলে, জেঠিমা এখনও মেলে রেখেছ! শুকিয়ে গেছে, এরপর রঙ জ্বলে যাবে। ভারি ভালো মেয়ে রে, মুখটাও কী মায়া কাড়া। "মায়া কাড়া!", আমি ভির্মি খেলাম। চা টা শেষ করে বেরোলাম। একটা ট্যাক্সি নিয়ে পাপোন আর মিমোকে তুলে নেব। কেয়া ওর বাড়ির গাড়িতে স্রাবন্তীকে নিয়ে আসবে। বিকেল চারটের মধ্যে সব মিটে যাবে হয়ত।

 

এখন সন্ধ্যে সাতটা বাজে। এখন লেক টাউনের দিকে একটা ঝিলের ধারে বসে আছি, কেয়া আসেনি, বেলা বারোটার পর থেকে ও আর ফোন তোলেনি, ওর কোনও বন্ধুই ওর খবর জানেনা বলছে। স্রাবন্তীকে ফোন করাতে বলল ও সিনেমাতে আছে, পরে ফোন করবে। সিনেমাতে! ও ত জানত আজ কী দিন, আমরা কী করব ঠিক করেছিলাম। বিকেল দুটোর দিকে মিমো, পাপোন কে বিদেয় করে দিয়েছি, একটা ট্যাক্সি ধরে কলকাতার অনেকটা জায়গা ঘুরলাম, এই জায়গাটাই সবচেয়ে নিরিবিলি মনে হল, আলোও কম। খুব কষ্ট করে সামলাচ্ছিলাম বটে কিন্তু তবুও ২-৩ বার চোখ থেকে জল বেরিয়ে এল। কিছু ছেলে মেয়ে প্রেম করছিল, ওরা একটা ছেলেকে কাঁদতে দেখে বেশ আমোদ বোধ করল। সিগারেট খেতেও ইচ্ছে করছে না, মাইগ্রেনের দপদপানি ব্যথাটাও বাড়ছে আস্তে আস্তে।

 

ঝিলের ধারের আলোগুলো এক এক করে নিভতে শুরু করল, কেউ একটা হুইসেল দিচ্ছে, কর্পোরেশন কর্মী হবে হয়ত, বলছে এখন ফোট সবাই, পার্ক বন্ধ করতে হবে। আমি বসে রইলাম, যদি নিতান্তই টেনে তোলে তবেই উঠব, সেরকম কিছু হলনা। কেউ কিছু বললনা। গেটে তালা ঝুলিয়ে চলে গেলো। তবে বেশী উঁচু গেট নয়, টপকে চলে যাওয়া যাবে।

 

মোটামুটি সাড়ে দশটা মত বাজে, তিন চারটে ছায়া মূর্তি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। এর মধ্যে একজন একটা খুব কঠিন গালাগালি দিয়ে বলল আমি এত রাতে এখানে কী করছি? আমি বলতে যাচ্ছিলাম তাতে তোমাদের কী ভাই? আমি ত" কাউকে বিরক্ত করিনি, কথাটা শেষ করতে পারিনি, একটা প্রচণ্ড জোর ঘুসি আমার বাঁ গালে এসে পড়ল। আমি বীরপুরুষ নই, তাই আমি অবশ্যম্ভাবী আত্মসমর্পণ করলাম।

 

মুখে একটা মানুষের রক্ত টাইপ স্বাদ লেগে রয়েছে, বাঁ চোখটাও ভালো ভাবে খুলতে পারছিনা। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ওরা আমার ঘড়িটা নেয়নি। দেখলাম প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। প্যান্টের চোরা পকেটে শ"তিনেক টাকা ছিল, অত খাটনি ওদের পোশায়নি হয়ত, মানিব্যাগে যা পেয়েছে তাতেই ওরা সন্তুষ্ট। আমি অনেক কষ্টে একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি এলাম, সে ব্যাটা আবার গলির ভেতর ঢুকবে না আর অতিরিক্ত ৫০ টাকাও নেবে। তাই নিল, এবং আমাকে মেইন রোডেই নামতে হল। পল্লি এলাকায় বাড়ি, মানে লোক জানাজানিটা হবেই। আমার বাড়ি অবধি আরও মিনিট দুয়েক হাঁটা। গলি পেরিয়ে বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি সে এক কাণ্ড। লোকজন ভিড় ভাট্টা, আমি একটু টাল খেতে একজন মেয়ে আমাকে আমাকে এসে ধরল, "কী অবস্থা তোমার পিক্‌লু দা! জেঠিমা...এস"। পিউ। অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পেলাম ও একটা ছোট্ট কালো টিপ পরেছে। একটা সালোয়ার গায়ে দিয়েছে, আমাকে ধরতে গিয়ে ওড়নাটা খসে পড়ল।

 

মা বেড়িয়ে এসে চেঁচামেচি কান্না-কাটি করে একটা হুলস্থূল কাণ্ড করল। ঘরে গিয়ে স্নান করলাম। কাটা জায়গা গুলোতে খুব জ্বালা করল, কিন্তু স্নানটা দরকার ছিল, বেশ ঝরঝরে লাগছে। তলপেটে সামান্য ব্যথা অনুভব করছি। চোখে মা আস্তে আস্তে ডেটল লাগাচ্ছে, খুব যে লাগছে আমার তা নয়, হয়ত প্রচণ্ড আঘাতে জায়গা গুলো একটু numb হয়ে গেছে। আমি জানলা দিয়ে দেখলাম পিউ ওর ঘরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে, ওখান থেকে চেঁচিয়ে বলল, "জেঠি, কিছু দরকার হলে জানিও...আমি জেগে আছি"। মা বলল, "তুই ঘুমুতে যা মা, আর কিছু লাগবে না"।

 

পিউ গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঘরটায় একটা জিরো পাওয়ার বাল্ব জ্বলছে। ওর মুখটা আবছা আলো-আঁধারি ভাবে দেখা যাচ্ছে। টিপটা দেখা যাচ্ছে না, খুলে ফেলেছে হয়ত। ওর চোখ থেকে গাল বেঁয়ে একটা রূপোলী রেখা নেমে এসেছে। আজ পূর্ণিমা, চাঁদের আলোয় সেটা আরও চকচক করছে। মা ঠিকই বলে, পিউ এর মুখে একটা স্বপ্নালু-মায়াবী ভাব আছে। আজ মনে হচ্ছে ও পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী। আমি এতদিন কেন বুঝিনি? কুৎসিত মানুষদেরই হয়ত প্রকৃত সৌন্দর্য দেরীতে ধরা দেয়।